যে কোন কলোনি লাইফে কলোনির নিজস্ব স্কুলের প্রভাব অপরিসীম। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশে সকল সরকারী কলোনিতে যারা বেড়ে উঠে, তারা নিজেদের মধ্যে সারাজীবন ধরে পরিচিত হয় কলোনি স্কুলের এসএসসি ব্যাচ হিসেবে। প্রাইমারির পর সিএসএম স্কুলে আর না থাকতে পারায়, কলোনির সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমার একটা দূরত্ব তৈরি হয়। তাও বিএইচ-ওয়ানে থাকায় কিছুটা ক্ষতিপূরণ হলেও, ক্লাস নাইনের শুরুতে সি-টাইপে চলে আসায় আমার বিচরণ সীমিত হয়ে পড়ে কেবলমাত্র সিএসএম স্কুলের কয়েকজন ব্যাচমেটের মধ্যে; তাও মূলতঃ সিএসএম স্কুল মাঠে আসর থেকে মাগ্বরিব ক্রিকেট খেলার মধ্যেই। কিন্তু যার যার স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর কলেজ লাইফে এসে আবার আমাদের ক্লাসমেট হওয়ার সুযোগ ঘটে। সেটা '৯৬-এর শেষে...
"ফার্স্ট ইয়ার, ড্যাম কেয়ার" (!) কলেজে এসে আমার আনন্দ সিএসএম স্কুলের ব্যাচমেটদের ফিরে পাওয়ার, আর তাদের আনন্দ কলোনির বাইরে প্রথমবারের মতো অবাধ স্বাধীনতা উপভোগের। আর যাওয়া-আসা যেহেতু ষ্টীল মিলের কলেজ বাসে সবাই মিলে একসাথে, সুতরাং হুল্লোড়ের মাত্রা কি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনের চাইতে কোন অংশে কম ছিল?
"এমনিতে নাচুনে বুড়ি, তার উপর ঢোলের বাড়ি!" মালয়েশিয়াতে শুরু হলো আইসিসি ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ানশীপ; আগেরবার কেনিয়া মিশনে হতাশাজনক ব্যর্থতার পর গর্ডন গ্রীনিজ আর গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর ম্যানেজমেন্টে এইবার বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপে উঠবার মরন লড়াই। আমাদের চাঁটগায়ের আকরামই যে অধিনায়ক, আছে আমার বরাবরের প্রিয় মিনহাজুল আবেদীন নান্নুও - সবাই প্রস্তুত, এইবার যেন "বজ্র আঁটুনির ফস্কা গেঁড়ো" না হয়। আর আমি তো "ক্রীড়াজগত"-এর নিয়মিত গ্রাহক; অতএব সবার টেনশনের পারদ আকাশ ছোঁয়ার মতো অবস্থা।
টিভিতে খেলা দেখাবে না, জাফর উল্লাহ শরাফতের "কর্দমাক্ত আকাশ" কিংবা "এইমাত্র বোলার তার ট্রাউজার খুলে আম্পায়ারকে দিলেন" এই মানের রেডিও ধারাভাষ্যের স্বর্ণযুগ তখন। চট্টগ্রাম কলেজে ওয়াহিদ, সনজয় ও মুরাদ এই ৪ জন আমরা একই সেকশনে, প্রাইভেট পড়া থেকে ফাঁকিবাজি - সারাদিন এক সাথে থেকে আক্ষরিক অর্থেই সব একসাথে। সকালে কলেজ বাস থেকে আমাদের আর চট্টগ্রাম কলেজে নামা হতো না, চলে যেতাম এমইএস কলেজে। ইস্পাহানী স্কুলের পাশের পাহাড়ের উপর নবাবী কায়দায় যে বাড়িটা, একেবারে উপরে তার গেইটের কাছে আসর জমাতাম আমরা, সাথে যোগ দিতো কমার্স কলেজ সিটি কলেজ মহসীন কলেজ থেকে আমাদের অন্যান্য ব্যাচমেটরা। কার্ড খেলার পাশাপাশি পোর্টেবল রেডিওতে ক্রিকেট ধারাভাষ্য চলতো। অদ্ভুদ এক সময় কাটছিল, একে একে ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্ত সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ - আর আমাদের এই কলেজ ফাঁকি দেওয়া মজমাও জমে উঠেছিল চরম। বাংলাদেশের অব্যাহত সাফল্য আমাদের ভেতরে কোন অপরাধবোধ যদি থেকেও থাকে, তা যেন ধুয়ে দিচ্ছিল।
তবে সেমিফাইনালের দিন, যার মাধ্যমেই মূলতঃ বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হয়, তখন কোন কারণে চট্টগ্রাম কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ক্লাস করছিলাম, সবার মন কিন্তু খেলাতেই। বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে সবাই মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসে, হস্টেল থেকে ছাত্ররা নিয়ে আসে থালা-চামচ - তাই দিয়ে হয় উদযাপন। সেই উচ্ছ্বাস ফিরে তাকালে আজো টের পাই...
[স্মৃতি হিসেবে কলেজ ফাঁকির আনন্দময় দিনগুলো তুলে আনলাম, অবশ্যই জুনিয়রদের কারো উচিত নয় তা অনুসরণ করা; তারা বরং এমন উদাহরণ সৃষ্টি করুক, যা একই সাথে মজার ও অনুকরণীয়]
{বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ বিব্রত হতে পারেন এই আশংকায় আমি চেষ্টা করেছি এই লেখায় সরাসরি কারো নাম যতটা সম্ভব কম নিতে; তবু যাদের নিয়েছি তারা কেউ বিব্রত হলে দুঃখিত লজ্জিত; জানালে অবশ্যই শুধরে নেব}
No comments:
Post a Comment