বাস থেকে নামতেই বৃষ্টি শুরু হল। এতক্ষণ কটকটে রোদ ছিল। হঠাৎ আকাশ কালো করে বৃষ্টি। আমি মাথা নিচু করে দৌড়ে একটা দোকানের ঝাপের নিচে ঠাই নিলাম। আমার বুক পকেটে একটা চিঠি। চিঠিটা ভেজেনি দেখে আশ্বস্ত হলাম।
আমার বুক পকেটে আমার ভাইয়ার চিঠি। ভাইয়া এক বছর হল চাকরিতে ঢুকেছে ভাল একটা লিজিং কম্পানিতে। ও আমার পাঁচ বছরের বড় কিন্তু সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। তুই তোকারি করি, মাঝে মাঝে ডাকিও নাম ধরে। ওকে দেখে আমার কখনো সিগারেট লুকাতে হয়নি। ও একদিন হঠাৎ একটা চিঠি আমাকে দিয়ে বলল ছোটন যা তো এটা মিতুকে দিয়ে আয়। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। মিতু কে, কি পরিচয় কিছুই তো জানিনা। তাছাড়া ভাইয়ার মেয়ে বিষয়ক আগ্রহের কথাও কখনো শুনিনি। ভাইয়াই বলে দিল নাসিরাবাদ ওমেন্সের সামনে জামিল স্টোরে দাঁড়াবি মিতুই তোকে চিনে নিবে। আমি খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললাম চিঠির দরকার কি ফোন করতে পারিস না? ভাইয়া বলল মিতুর নাকি চিঠি পেতে ভাল লাগে। আমি চিঠি নিয়ে গিয়ে জামিল স্টোরে দাঁড়ালাম। একটু পর একটা মেয়ে এলো। ছিপছিপে গড়ন। শ্যামলা চেহারা। মায়া মায়া দুটা চোখ। আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে। প্রথমদিন মিতুর সাথে আমার টুকটাক কিছু কথা হল।
এরপর থেকে প্রায়ই চিঠি নিয়ে জামিল স্টোরে গিয়ে দাড়াতে হয়। মিতুর সাথে কথা বলতে আমার ভালই লাগে। ওকেও নাম ধরেই ডাকি আমি। মেয়েটার মধ্যে একটা মুগ্ধতা আছে। ও যেমন সবকিছুতে মুগ্ধ হয় তেমনি নিজের মুগ্ধতা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে জানে।
আধঘণ্টা হল দোকানের ঝাপের নিচে দাঁড়িয়ে আছি বৃষ্টি কমার কোন লক্ষন নেই। এর মধ্যে তিনটা সিগারেট খেয়ে ফেলেছি। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে কিন্তু এ দোকানে চা নেই। এরকম বৃষ্টি দেখলেই বাবা মাছ ধরার গল্প শুরু করে। বাবার ঝুলিতে থাকা সব গল্প আমাদের মুখস্ত হয়ে গেছে। অবসরে যাওয়ার পর থেকে খেলাধুলার প্রতি বাবার অদম্য আগ্রহ তৈরি হয়েছে। খেলাধুলা বিষয়ে বাবার সাথে আমার কথোপকথনের নমুনা অনেকটা এরকম-
ছোটন দেখছস অস্ট্রেলিয়া তো ইন্ডিয়ার মুখে কালি দিয়া দিছে।
ও।
ইন্ডিয়া আজকে দাঁড়াইতেই পারে নাই।
তাই নাকি?
গেইল তো রাহুল শর্মার নেংটি খুইলা নিছে একদম।
বলো কি?
এরপর বাবা মায়ের কাছে গিয়ে আমার নামে অভিযোগ করে-
'তোমার ছোট ছেলেটার মানসিক সমস্যা আছে। এই বয়সে খেলাধুলা নিয়ে কোন আগ্রহ নাই।'
মা প্রত্যুত্তরে বলে তোমারও তো একই সমস্যা সারাজীবন দেখলাম না তোমাকে খেলা দেখতে। এই বুড়ো বয়সে খেলা নিয়ে পোলাপানের মতো লাফালাফি।
বাবা গজগজ করতে করতে চলে যায়। বাবার সাথে ভাইয়ার মিলে ভাল। ভাইয়ার প্রিয় দল ইন্ডিয়া আর বাবার পাকিস্তান। বাবা আর ভাইয়ার প্রতিপক্ষ দল নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলা শুনতে আমার ভাল লাগে।
বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। আমি ঝাঁপের নিচ থেকে বেরিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। জামিল স্টোরের কাছে গিয়ে দেখি মিতুর বান্ধবী তুর্না দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে হাত উঁচু করে ডাকল। কাছে যেতেই বলল মিতুর কাছে এসেছ? আমি বললাম হু। ও কোথায়? তুর্না হড়বড় করে যা বলল সোজা কথায় তা দাঁড়ায় আজ সকালে মিতুর হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে আর্মির বড়দরের কিছু একটা। মিতুর বাবা এত ভাল পাত্র হাতছাড়া করতে চায়নি। তুর্নাকে কি বলব বুঝতে পারলাম না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
জামিল স্টোর থেকে বেরোতেই আবার বৃষ্টি শুরু হল। এবার আর দোকানের ঝাঁপ খুজলাম না। কেন যেন ভিজতেই ভাল লাগছে। ফোনের আওয়াজ পেয়ে বের করে দেখি ভাইয়ার ফোন।
ছোটন, চিঠিটা দিসনা বুঝছিস। বাসায় চলে আয়। বৃষ্টি শুরু হয়েছে ভিজিসনা কিন্তু।
তুই অফিসে যাসনি ভাইয়া?
গিয়েছিলাম, চলে আসছি। মা খিচুড়ি রান্না করছে। বৃষ্টিতে ঘুরাঘুরি করিসনা। বাসায় আয় একসাথে খাব।
বুক পকেট থেকে চিঠিটা বের করলাম। একদম ভিজে গেছে পিন দিয়ে আটকানো চিঠিটা। যা কখনো করিনি আজ তা করলাম। সাবধানে খুললাম কাগজটা। কোন সম্বোধন নেই উপসংহার নেই শুধু একটুখানি কবিতা-
জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে
আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়,
আমার কাতর চোখ,আমার বিমর্ষ ম্লান চুল
এই নিয়ে খেলা করে
জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে।
যা এতক্ষণ বুকের ভিতর চেপে রেখেছিলাম তা হঠাৎ বেরিয়ে এলো। বৃষ্টিতে তো ভিজতে আমাকে হবেই আজ।
(২০/০৫/২০১৩)
No comments:
Post a Comment