Tuesday, January 5, 2016

স্বর্গভ্রষ্ট



আমরা কলোনিতে ঢুকেছিলাম ১৯৮৭ সালে। জুন মাসে। আমার বয়স তখন আট কি নয়। তখন স্টিলমিলের রমরমা অবস্থা। নতুন কেউ বাসা পেলে তখন বাসার দরজা, জানালা ঠিক করে দেয়া হতো। আমরা ঢুকে দেখি তখনো কাঠের কাজ শেষ হয়নি। আমার পা ভাঙ্গা থাকায় উরু পর্যন্ত প্লাস্টার দেয়া ছিলো। আমি সারাদিন বসে সেই প্লাস্টারে ছবি আঁকতাম বা একা একা বসে ক্যারম খেলতাম। সেবছরই আমি মাত্র ক্লাস থ্রি তে ভর্তি হয়েছিলাম স্টিলমিল স্কুলে। কিছুদিন ক্লাস করতে না করতেই পা ভাঙ্গার বিপত্তি। তাই প্রথম অনেকদিন আমার কলোনির সাথে পরিচয় হয়নি। আমাদের বাসার সামনে ছিলো জঙ্গলে ভরা। জঙ্গলে ছেয়ে গিয়ে জায়গাটা এতই সবুজ হয়ে ছিলো যে সকালে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে সারা ঘর সবুজ হয়ে যেতো। তখন আমার বারান্দা থেকে বা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর তেমন কিছুই করার ছিল না তাই সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। 


দেখতাম একটা রক্তচোষা আমার জানালার নিচ দিয়ে হেঁটে যায়। দেখতাম কাদের যেন একটা খয়েরি রঙের হাঁস রোজ রোজ ঝোপের ভিতর ডিম দিতে আসে। একটা টুনটুনি জঙ্গলে কি একটা বুনো গাছের পাতা মুড়িয়ে বাসা বেঁধেছিল, ডালে বসে সারাদিন টুইক টুইক করে ডাকতো। মাঝে মাঝে স্কুলের নতুন বন্ধুরা দেখতে আসতো আমাকে। মনে আছে আমি মহাবিরক্ত হতাম। সবাই কি সুন্দর হেঁটে হেঁটে বেড়ায় আর আমি সেই কবে থেকে ঘরে বসে আছি। আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে আমার পায়ের প্লাস্টার খোলা হলো। এর পরের একমাস আমাকে নতুন করে হাঁটা শিখতে হয়েছিলো। সত্যিই হাঁটা ভুলে গিয়েছিলাম আমি। এরপরেও অনেকদিন আমি বাসা থেকে বের হয়ে টাংকির গোড়া বা স্কুল এর বেশিদূর কোথাও যেতাম না। বেশি হাঁটলে পায়ে প্রচন্ড ব্যথা হতো বলে বাসার কাছাকাছিই থাকতাম। 

কিন্তু এ কদিনেই আমি কলোনিতে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মুগ্ধতার প্রথম কারন নারকেল গাছ। কলোনিতে ঢুকার আগে যে বাসায় ছিলাম সেখানেও অনেক গাছগাছালি ছিলো কিন্তু নারকেল গাছ ছিলোনা এতো। আরো মুগ্ধ হয়েছিলাম মানুষ দেখে। আগে যেখানে ছিলাম সেই জায়গাটা জনবিরল ছিলো। আট নয় বছর বয়সী একটি বালকের তখন সব কিছুতেই বিস্ময়। সেই বিস্ময় আরো বাড়ল নারকেল পাতায় বৃষ্টির শব্দ শুনে। সাহিত্যের অনেক পাতায় আমি টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের কথা পড়েছি কিন্তু কোথাও কখনো দেখিনি নারকেল পাতায় বৃষ্টির শব্দের কথা বলতে। বলবেই বা কিভাবে? এতো নারকেল গাছ আর কোথায় ছিলো? সারারাত বৃষ্টি, আর বৃষ্টির ফোঁটা চিরল চিরল নারকেল পাতায় পড়ে অনবরত বাজনার মতো বাজছে, আমি জানিনা এর চেয়ে সুমধুর সঙ্গীত পৃথিবীতে এখনো তৈরি হয়েছে কিনা। 

আমার পা ভালো হয়ে যাবার পর আমি আর আব্বা দিনের পর দিন পরিশ্রম করে সামনের জঙ্গল সাফ করে ফেললাম। এরপর শুরু হল বাপ ব্যাটা মিলে কৃষি গবেষণা। আমরা মাটি কুপিয়ে বীজ বপন করি, চারা গজানোর দুদিনের মাথায় গাছ নেতিয়ে পড়ে। পিঁপড়া। সারা জমি ভর্তি পিঁপড়া। প্রথম বছর আমাদের সব চারাগাছ পিঁপড়ার পেটে গেলো। দ্বিতীয় বছর গাছ ঝাঁপিয়ে ফলন এলো আমাদের। টমেটো, বেগুন, লালশাক, ডাটা যা লাগাই উজার করে ফলন দেয়। সেসময় বিটিভি তে প্রতি সোমবার শাইখ সিরাজের "মাটি ও মানুষ" প্রচারিত হতো। আমাদের কৃষি সাফল্যের পর আমি নিয়মিত "মাটি ও মানুষ" দেখা শুরু করলাম।

কলোনিতে আকাশের পরিধি ছিলো অনেক বেশি। এখন উপরে তাকালে আকাশ দেখি অল্পই বাকি সব সিমেন্টের জঙ্গল। যেটুকু আকাশ দেখা যায় তাও ধুসর। কলোনির আকাশ ছিল ঘন নীল। মাঝে মাঝে ছাদে উঠে লম্বা হয়ে শুয়ে আকাশ দেখা হতো। মেঘদলের হেঁটে যাওয়া দেখতে দেখতে মনে হতো আমিও উড়ছি। শরতের সেই আকাশের দৃষ্টিসীমায় মাঝে মাঝে ঢুকে যেতো রংচঙয়ে ঘুড়ি। অবাক ব্যাপার আমি কখনো ঘুড়ি উড়াইনি। 

ভীষণ বর্ষায় কখনো কখনো কলোনির বড় বড় ড্রেনগুলো উপচে রাস্তায় পানি জমে যেতো। মাঠে ফুটবল খেলার উৎসব লেগে যেতো তখন। আমি কখনোই খেলাধুলায় খুব বেশি উৎসাহী ছিলাম না তবু মাঝে মাঝে এমন ঘন ঘোর বর্ষায় আমিও মাঠে নামতাম। ভর দুপুরে কাথামুড়ি দিয়ে জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখেছি কতো। কাগজের নৌকা বানিয়ে ছেড়ে দিতাম জমে থাকা পানিতে। সেই নৌকা মনের আনন্দে দুলতে দুলতে একসময় নেতিয়ে পড়তো।

আজো আগের মতই সূর্য উঠে আগের স্থানে। একই বর্ষার জল আকাশ থেকে নেমে সে মুখ থুবড়ে পড়ে একই মাটিতে। সেই আকাশটাই আগের মতো ছাদ হয়ে আছে আগের জমিনের উপর। শুধু আজকের সূর্যের আলোয় পানির ট্যাঙ্কের ছায়া লম্বা হতে হতে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে যায়না। সেই আকাশ উঁচু দালানের দাপটে ছোট হতে হতে এখন দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের পাতা হয়ে গেছে। একই বৃষ্টিজল এখন আর নারকেল পাতার সাথে যুগলবন্দী করে না। পিঁপড়েরা এখন আর দল বেঁধে এসে একটি বালকের শখের কচি চারাগাছ খেয়ে যায়না আগের মতো। আমি যুক্তিহীন ভাবে এখনো আশায় থাকি একদিন দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখবো আমার জানালা লাগোয়া নারকেল গাছের পাতায় বসে একটা দোয়েল একমনে শিষ বাজাচ্ছে।

No comments:

Post a Comment