Monday, September 21, 2015

" কোন এক রাজা মিয়া"


আনেক দিন আগে এ লেখাটা আমার টাইম লাইনে দিয়ে ছিলাম। যেহেতু বিষয়টা ষ্কুলের সাথে জড়িত তাই আবার সবাইকে বিরক্ত করার জন্য পোষ্ট কররাম-
------------------------------------------------------------------------------------------------
" কোন এক রাজা মিয়া"

এমন একটা জায়গায় খুক খুক করে গাড়ি থেমে গেল যেখানে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকেও রিক্সার/সিএনজি-র কোন দেখা পেলাম না। অগত্যা ড্রাইভারের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে মোড়ের দিকে হাঁটা দিলাম। হাতে সময় কম একটা সেমিনারে যোগ দিতে হবে। অভিজাত নিরিবিলি এলাকা।আগের দিনের নাপিতের বাক্সে মত হাতে একটা ছোট ব্রিফ কেস নিয়ে কেতাদুরস্ত পোষাক পরে হাঁটছি।মোড়ের কাছে আসতে আসতে ঘেমে নেয়ে উঠলাম। ভাদ্র মাসের তালপাকা গরমের ভরদুপুর। মোড় ঘুরতেই দেখি এক রিক্সাওয়ালা সিটে বসে পায়ে উপর পা তুলে ভুর ভুর করে বিড়ি ফুঁকছে। ভাড়া যাওয়ার ঠিকানা শোনে একই ভঙ্গিতে বলল---ঐ দিকে vip রোড। যাওয়া যাইবো না।


---আরে ভাই ভাড়া যা লাগে দিব । পুলিশকে যদি কিছু বলা লাগে আমি বলব।
---পুলিশ তো আপনারে কিছু জিজ্ঞেস করবো না । ডান্ডা তো আমারে মারবো ।
এ কথা বলে রিক্সাওয়ালা নির্বিকার বিড়ি টানায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এ সময় মেজাজ দেখিয়ে লাভ নেই।গলায় মধু ঢেলে কাতর গলায় তাকে অনুরোধ করছি।সে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে শুধু বললো—উঠেন।
রিক্সা চলছে।চাকার শাঁ শাঁ আওয়াজ ছাড়া কোন শব্দ নেই।চলতে চলতে আচমকা রিক্সাওয়ালা বলে উঠলো--- চাচা/চাচি কেমন আছে?আপনার ছোট ভাইটা এখন কত বড় হইছে? সে কি করে---
আমি চমকে উঠি। এ ব্যাটা এ সব কি বলছে! আমাকে চিনে কোথা থেকে! আমি এড়িয়ে যাওয়ার মত করে বলি ---‘ভাল। সবাই ভাল।

----আপনার ছোট ভাই কি যেন নাম। খুব দুষ্ট ছিল। আপনার হোম ওয়ার্কের খাতায় ছবি একে রাখতো। আপনার টেবিল ঘড়িতে সময় আগাইয়া পাছায়া রাখতো। কখনো মধ্যরাতের এ্যলার্ম দিয়ে রাখতো। তার কথা বলছিলাম আর কি?
আমি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করি---ভাইরে, তুমি কে?এ সব তো আনেক দিনের পুরাতন কথা।তুমি আসলে কে?
অনেকটা টেনে টেনে সে জবাব দেয়—আমারে না চিনাই ভাল। আপনারে দেইখ্যা ভাল লাগলো। অনেক বড় মানুষ হইছেন। আল্লাহ ভাল রাখুক।
----আরে ভাই তোমার পরিচয়টা তো বল?
----একজন রিক্সা আলার পরিচয় দেয়ার কি আছে।
এসব কথাবার্তার ভেতর সে একবারও পিছন ফেরেনি। কথায় কথায় এ রোড সে রোড করে, এক রাস্তার মাথায় সে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমার দিকে ফিরে বলল---আর যাওয়া যাইবো না।যে অফিসের কতা কই ছিলেন, তা সামনের ঐ গোল চক্কর ঘুরে ডান হাতের দশতালা বিল্ডিং।যাইতে ৫/৭ মিনিট লাগবো।
আমার মাথায় তখন সেমিনারের চেয়েও তার পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো।

----তোমার নামটা তো অন্তত: বল?
----নাম কইলে চিনবেন? রাজা মিয়া। কোনদিন আপনার সাথে একই স্কুলে সিক্স পর্যন্ত পড়ছিলাম।
আমি বোবা হয়ে গেছি রাজা মিয়াকে দেখে।ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় হঠাৎই কাউকে কিছু না বলে রাজা মিয়া স্কুল থেকে চলে যায়।রাজার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি তাদের বাসায় তালা। তাকে আমরা আর কখনো দেখিনি।আজ এতো বছর পর তাকে দেখে বললাম---একে বারে বুড়ো হয়ে গেছিস।হঠাৎ করে কোথায় গায়েব হয়ে গিয়ে ছিলি।তোরই বা এ অবস্থা কেন?
----অনেক কথা।সবই কপাল স্যার।সময়ের কাছে হাইরা গেছি। আপনার সময় কম আগায়া যান।
---আরে এখনও তুই ‘স্যার—আপনে’ বলছিস কিরে!
রাজা হেসে দিয়ে বলল-আপনার সন্মান আছে।যতটুকু কইছেন আর কইয়েন না।আমারে চিনছেন এটাই অনেক কিছু... 
হঠাৎ আমাদের কথার মধ্যে অল্প বয়স্ক দু’টি ছেলে মেয়ে উদয় হলো। রাজাকে উদ্দেশ্য করে বলল—মামা যাইবা? (এখন নিম্ন শ্রেনির শ্রমজীবি সকল মানুষই আধুনিক ছেলে মেয়ের কাছে ‘মামা’ হয়ে গেছে।পরিবর্তনের হাওয়া।)
রাজা হা সূচক জবাব দিতেই দু;জনে রিক্সায় উঠে হুড টেনে দিল। ভাবটা এমন, কেউ যেন দেখে না ফেলে।
আমি কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই রাজা মিয়া মুচকি হেসে রিক্সা টেনে দৃ্ষ্টির আড়াল হয়ে গেল।
আরে ছি ছি ভারাটাই তো ওর দেয়া হয়নি।একদিন ছোটবেলায় সবার সামনে কুস্তি ধরে হারিয়ে দিয়েছিল। আর আজ, আবারও ওর সামর্থ দিয়ে হারিয়ে দিয়ে গেল।

উপরের ঘটনাটি নিছক পথের গল্প। তবে আমার দেখা রাজা মিয়ার বাস্তব জীবন গল্পকেও হার মানায়।ইচ্ছে হলেই গল্পের রাজা মিয়ার সাথে দেথা করা যায়, কথা বলা যায় কিন্তু বাস্তবের ছিটকে পড়া রাজা মিয়াদের সাথে যদিও কদাচিৎ দেখা মিলে কিন্তু তার সাথে কথার মত কথা অথবা দেখার মত দেখা কোন দিনই হয় না।

এবার সত্যিকারের একজন রাজা মিয়ার কথা বলি----এ নামে একটা ছেলে আমাদের সাথে ষ্টিল মিল স্কুলে পড়তো। তার বাবা কোন এক মিলের সাধারণ শ্রমিক ছিলেন। রাজা অধিকাংশ সময় ক্লাসে মনমরা থাকতো। শান্তি বাবু স্যার অত্যান্ত রসিক এবং দরদী মনের মানুষ ছিলেন। তিনি হয়তো রাজা মিয়ার কিছু জানতেন। তাই ক্লাসে ঢুকেই রাজা মিয়াকে উদ্দেশ্য করে তোতলা মানুষের মত বলতেন- ‘রা--রা-- রাজাইয়া, পড়া বল’। এ কথায় রাজা মিয়া হেসে দিত। কখনও পড়া পারতো আবার কখনও পড়া পারতো না। কিন্তু স্যার কিছুই বলতেন না। তখন ক্লাস সিক্স-এ পড়ি। হঠাৎ করে রাজা মিয়া স্কুলে আসা বন্ধ করে দিল। বেশ কিছু দিন পর স্টীল মিল বাজারে দেখি---রাজ মিয়া গায়ে পুরাতন শার্ট-লুঙ্গি, পায়ে রাবারের নাগরা জুতো।রাজা মিয়া রিক্সা চালকের সিটে বসা। আমাকে দেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রিক্সা ঘুরিয়ে চলে গেল। তখনও সে রিক্সার প্যাডেল ঠিকমত নাগাল পেত না। ঘটনাটা ক্লাসে এসে বলতেই রিপন(বর্তমানে চট্টগ্রামে শিশু রোগবিসেষজ্ঞ ডা: নাজমুল হুদা ) জানালো-ওর বাবা আর একটা বিয়ে করেছে। রাজা মিয়াকে তার মা-ভাই-বোনসহ বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। আমারা সবাই সেদিন রাজা মিয়ার জন্য খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। রাজা মিয়া ছিল তার মা'র বড় ছেলে। তাই সংসারের দায়িত্বটাও তার । কখনও তাকে ঘামে ভেজা শরীরে হাপাতে হাপাতে যাত্রী টানতে দেখতাম, কখনও রাস্তার মোড়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে দেখতাম। আমাদের দেখলে না চেনার ভান করতো। কথা বললে কোন কথার উত্তর না দিয়ে দ্রুত চলে যেত।আমাদের বন্ধু রাজা মিয়া কি এক অদ্ভুত পালায়নপর অচেনা মানুষ হয়ে গেল।যার চেহারায় মেশানো থাকতো ক্ষোভ-ঘেন্না-অভিমান আর-কষ্টের আবরনে ঢাকা সীমাহীন লজ্জা । 

তারপর ক্লাসে না আসার মতই, হঠাৎ আমাদের রিক্সাওয়ালা রাজা মিয়াকে আর কোথাও কোন দিন দেখিনি। রাজা মিয়া কোথায়, কিভাবে, কেমন আছে কে জান।

No comments:

Post a Comment

Comments

Not using Html Comment Box  yet?

No one has commented yet. Be the first!

rss