Tuesday, September 29, 2015

লুলু পাগলা


মাঝে মাঝে আমার পুরাতন পোষ্ট বের করে পড়ি। নিচের পোষ্টা তেমনি একটা লেখা। যখন এটা আমার টাইম লাইনে দেই তখন সিএস এম কলোনীর এ পেজটার জন্ম হয়নি। ভাবলাম কলোনীর সবার জন্য আবার পোষ্ট করি-----------------
লুলু পাগলা

এমন কোন কবি-লেখকদের আড্ডা নেই যেখানে তাকে পাওয়া যেতোনা। একমুখ ঘন গ্যাজালো সাদা লম্বা দাড়ি, মাথায় কোঁকডা সাদা চুলের কাশবন।সেখানে থেকে থেকে দু’একটা কালো চুল তখনো অতীতের গৌরবময় স্মৃতি ঘোষণা করছে। নাক মুখ তীক্ষ্ণ ধারালো। গোল চশমার পেছনে সম্মোহন করার মত চোখ। ঠোটে একটা দুষ্ট হাসি ঝুলেই থাকতো। কোন কথা বলার পর প্রাণ খোলা পরিচ্ছন্ন হাসি। এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম তিনি আমাদের কবি সামশুল আলম ওরফে লুলু ওরফে লুলু পাগলা তার আরেকটা নাম আমরা দিয়ে ছিলাম-ঠাকুর।তবে আমরা কেউ লুলু ভাই আবার কেউ ঠাকুর বলে ডাকি(ঠাকুর বলে ডাকলে তিনি ভীষণ খুশি )।পাগলের হাসি সুন্দর আর সরল।তার হাসি দেখলেই বোঝা যেতো তিনি ঐ শ্রেনির অন্তরগত।বয়স অবশ্যই ৭০-এর উপর হবে।বয়সের ওজনে শরীর সামান্য ধনুক বাঁকা।হাড্ডিসার শরীরে উচ্চ রক্ত চাপ নিয়ে তিনি প্রগৈতিহাসিক যুগের রেলিং সাইকেলে প্যডেল মেরে সারা কুষ্টিয়া ঘুরে বেড়ান।যতবড় আর দামি অনুষ্টানই হউক না কেন আমাদের ঠাকুর লুঙ্গি-সার্ট আর রাবারের সেন্ডেল ছাড়া দ্বিতীয় কোন পোষাক পড়তেন না।দেখা গেল রবীন্দ্র কুঠি বাড়ি বা শহীদ মিনরে অথবা শিল্পকলা একাডেমিতে যথা সময়ে তিনি ঐ পোষাকে স্টেজেউঠে পড়লেন।ঠাকুরের হাতে থাকতো বাজারের থলে ভর্তি রাজ্যের লেখালেখির পান্ডুলিপি ।তবে কোন আড্ডায় তাকে তেমন একটা কবিতা পড়তে শুনতাম না। আড্ডায় যা সাধারনত: হয়--- লেখা পড়া- আলোচনা-সমালোচনা কখনো মন মতো মন্তব্য না হলে আলোচকের উপর আকারে ইংগিতে কথার ঝড় বইয়ে দেয়া, এর কোনটাতেই লুলু ভাই নেই।একবারই শুধু কি একটা বিষয় নিয়ে যেন অধ্যাপক মিজান সাহেবের সাথে জম্মের লাগা লাগেছিল।ব্যতিক্রমি মানুষ অল্পদিনেই অন্তরঙ্গ এবং যথারীতি এক বৃদ্ধের সাথে বন্ধুত্ব। আড্ডা শেষে নিচু গলায় আমার লেখার খুঠি-নাটি ধরে মন্তব্য করতেন উপদেশ দিতেন। কখনো তা শুনতাম আবার কখনও হু হা করে পাশ কাটাতাম। তার লেখায় কখনো মানুষ,কখনো সমাজের অসংগতি আবার কখনো ঈশ্বরের কাছে প্রর্থনার কথা সুন্দর ভাবে ফুটে উঠতো।যা এক কথায় ভালই লাগতো।


মাসখানেক আগে রাত ১২টার দিকে বাসায় ফিরছি ট্রাকষ্টান্ডের সামনে লুলু ভাই। সেই চেনা পোষাকে । তবে চেহারাটা মলিন।---‘আরে লুলু ভাই এতো রাতে এখানে ?
একটু অপ্রস্তুত তারপরই সেই পাগলা হা হা হাসি।যেন মজার কিছু ঘটে গেছে। একটু নিচু গলায় বললো----‘ভাই গো, জীবন আর চলে না।গাড়ী পাহাড়ার কাজ নিছি।নাইট গার্ড’।
আবারও ইতস্ততভাব মুখে মলিন হাসি। আমি তাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম---‘এটাতো ভাল কাজই। আপনি লজ্জা করছেন কেন’।

‘হা…..হা লজ্জা।না লজ্জা কিসের’।
এরপর সংক্ষেপে বলে গেলন কিভাবে বাজারের চারটা দোকানের ব্যবসা ধ্বংস হলো। বাড়িতে সাইকেল রিক্সার বল-টিউব বানানোর ওয়ার্ক সোপ তাও চলে না। ঘন্টাখানেক নানা কথাবর্তা বলে বাসায় ফিরলাম।এভাবে তার সাথে প্রতিদিন দু’বার দেখা হতো । একবার রাতে আবার সকালে যখন হাটতে বের হতাম।রাতেই আমাদের আলাপ জমতো বেশী।নানা বিষয়ে কথা চলতো সাহিত্য-সমাজ-পরিবার-দেশ নিয়ে।অবাক হতাম এসব বিষয়ে তার গভির দৃষ্টি ভঙ্গি দেখে।তার সাথে দেখা হলেই মনে হতো তিনি আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন।

যাক,আমি তো জানি দিনের পর দিন রাত জাগা কি কষ্টের।অল্পদিনের ভিতর লুলুভায়ের শরির ভেংঙ্গে পড়ল।একদিন বললো..
---‘আর পারিনা ভাই, কোন বাসা-বিল্ডিং-এ দেখেন তো দারোয়ানের বা অন্য কাজ পান কিনা।এখানে বেতনও দেয় কম’।
বললাম—‘এরা কতটাকা দেয়’?
------------‘তিন হাজার,।

মুখে আর কিছু বললাম না।চলে এলাম বাসায়।হায়রে জীবন! এতো কম হয় বৃদ্ধকালের রাত্রের দাম ?
সেদিন কোন প্রকার কথাবার্তা ছাড়াই লুলু ভাই আমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বললো—‘ আচ্ছা আমাদের এ মুসলমান জাতটার অবস্থা দেখেন।যেমন এদের নৈতিক অধপতন হয়েছে তেমনি ধর্মীয় রীতি নীতিরও কেউ তুয়াক্কা করে না।তো শালারা তোরা মাইর খাবি নাতো অন্যরা খাবে ? এ বিষয কিছু লেখেন তো।আমিও লিখতে হাত দিয়েছি।আগামী মে/২৯ তারিখে লেখক ফোরামে দু'ভাই একটু এ বিষয় ঝারি। কথাগুলি এক দমে বলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

আমি বললাম---------‘যাদের উদ্দেশ্যে লিখবেন তারা কি আপনার আমার কথা শুনবে’?
---‘শুনবে না জানি। লেখেতো ওদের জন্য আমাদের ঘৃনাটা রেখে যেতে পারি’।
সেদিনের মত কথা আর এগুলোনা। রাত বেশী হয়ে গিয়ে ছিল।বাসায় ফিরলাম।

পরদিন ২৭/মে ঠাকুরকে দেখলাম না। সকালেও দেখা পেলাম না। দুপুরে মোবাইল পেলাম।গতকাল বিকালে আমাদের লুলু ভাই মারা গেছেন। রাতেই দাফন হয়ে গেছে।মনটা কেন যেন হা হা কার করে উঠলো।বারবার কানে বাজতে থাকলো—‘ভাই গো, জীবন আর চলে না’।৭০ উর্ধ এক বৃদ্ধকে সংসারে টিকে থাকার জীবনপণ সংগ্রাম থেকে মুক্তি দিয়েছে জীবন।অথচ তার এ বয়সে কতকিছুই তো সুন্দর গোছালো হতে পারতো।কেন যেন ঈশ্বরকে সময় সময় বড় খেয়ালি মনে হয়।

বিকালে ছুটলাম ঠাকুরের ঠিকানায়।লুলু পাগলার বাড়ী লোকজনে দেখিয়ে দিল। গাছ-গাছালিতে ঝাপটে ধরে আছে আমাদের কবির বাড়ী।বাহিরের উঠুনে তখনো ভেজা মাটি।একটা খাটিয়া কাত করে রাখা।মাটিতে পড়ে আছে আগর বাতির পোড়া অংশ, সাবানের মোড়ক। এখানেই জীবনের শেষ গোসল দেয়া হয়েছে আমাদের কবিকে।কত দিন অনুরোধ করেছে এ বাড়িতে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য।নানা কারনে আসা হয়নি।অথচ আজ যখন বিনা দাওয়াতে হাজির হলাম।তখন বাড়ির মালিক তার মালিকানা নি:শব্দে ছেড়ে দিয়ে চিরদিনের জন্য দেশান্তরী হয়েছেন।

কাঁদতে কাঁদতে কবির ছোট ছেলে-নাতি তার লেখা নোট বই গুলি দেখালো।কিছুক্ষণ লেখা পড়ার চেষ্টা করলাম বার বার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল।কি হবে এ সব পড়ে। আমি জানি লুলু ভাইয়ের সারা জীবনেও কোন কবিতার বই বের হয়নি।কোন কবিতা জাতীয় পত্রিকায়ও বের হয়নি ।আগামীতেও হয়তো বের হবে না।একদিন দেখা যাবে পান্ডুলিপির পাতায় কোন এক মুদি দোকানে ঠোঙ্গা তৈরী হয়েছে। তাতে নুন-ডাল বিক্রি হচ্ছে।তারপর একদিন কেউ জানবেনা-বলতেও পারবেনা লুলু নামের কোন কবি ছিল।লুলুদের জীবন তো এমনই হয়।এ আর এমন কি?

No comments:

Post a Comment

Comments

Not using Html Comment Box  yet?

No one has commented yet. Be the first!

rss