Saturday, October 10, 2015

কানে ধরার দল


সব যুগের স্টুডেন্টদের যদি একটা প্রশ্ন করা হয় আপনার সবচেয়ে মজার সময়টা কখন কেটেছে ? আমার ধারনা সবাই স্কুল লাইফেই বেছে নিবে । আমি ও ব্যাতিক্রম না। আমি ও সেই লাইফ কেই খুজে নেই ,কখনো মন খারাপ থাকলে আমাকে সেই লাইফেই ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। যাই হোক আমি একটু ভদ্র গোছের ছেলে ছিলাম ,জাহাঙ্গির এর ধারনা আমি সুযোগের অভাবে ভদ্র ছিলাম। কি জানি হবে হয়তো। গুরুর কথা অমান্য করি করে grin emoticon ক্লাস নাইন/টেন এ আমাদের ক্যাপ্টেন ছিল জাহাঙ্গির । এই ছেলে কোন স্ট্যান্ডার্ডের ফান করতে পারে কেউ ধারনাই করতে পারবে না। আমাদের ক্লাসে পজিশন ছিল ফাষ্ট বেঞ্চে। ফাষ্ট বেঞ্চে বসলে মজা করা যায়না এই রকম ধারনা আমরাই সম্ভবত প্রথম ভেঙ্গে দিয়েছিলাম। মাহফুজ স্যার / আনোয়ার স্যার এর মাইড় খেয়ে তত দিন আমাদের পিঠের চামড়া গন্ডার এর মতো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখনো মনের পর্দা অতটা শক্ত হয়ে উঠেনি। ক্লাস টিচার মহসিন স্যার এর ধমক শুনে মন প্রায় খারাপ হয়ে যেতো । ব্যাপারটা জাহাঙ্গির খেয়াল করে। আমাকে অনেক জ্ঞান দিতে থাকে । কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। আমাকে নিয়ে এক রকম ঝামেলায় পরে যায় জাহাঙ্গির। কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়নি ।


সেই সময়ে কেন জানি আমাদের তখন টিফিন আওয়ারের পর আমাদের ক্লাস করতে ইচ্ছে করতো না, কখনো বৃষ্টিতে ভেজার অজুহাতে কখনো প্রচন্ড গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি লোডশেডিং চলছে এইরকম অজুহাতে ছুটি চাইতাম কোন দিন ছুটি পেয়েছি বলে মনে হয় না , অনেক ধমক ঝুটতো কপালে ,এক কলমে ডিগ্রি পাস নামক বেত এর কোমল স্পর্শ মাঝে মাঝে আমাদের একাউন্টে এড হতো !! আমরাও দেখে নিতাম, আমাদের উপর অত্যাচার অন্য বন্ধুরা মেনে নিতে পারতো না, শুরু হতো প্রতিবাদ, একেবারে রাজনৈতিক দলের সংসদ বয়কটের আদলে আমরা করতাম ক্লাস বয়কট। স্কুলের পাশেই একটা লেক ছিল সেখানে আমাদের আড্ডা চলতো ,স্কুলের বাউন্ডারি পার হতে আমার অনেক কষ্ট হতো , জাহাঙ্গির প্রতিবার আমাকে অনেক কষ্ট করে পার করে দিত, কাজীও প্রায় এই মহৎ কাজে পাশে থাকতো । আমি বাউন্ডারির উপর পর্যন্ত উঠে আর ঝাপ দিতে চাইতাম না। কাজী/ জাহাঙ্গির/ সোহেল তিন জন আমাকে ঝাপ দিতে অনুপ্রানিত করেই যেতো। এক সময় কাজী বলেই বসে তুই ঝাপ দে আমি নিচ থেকে তোরে ধরবো। কাজী সাহস দিলে তো কথাই নাই । যা থাকে কপালে বলে দিলাম আল্লাহর নামে লাফ। পুরা বাংলা ফিল্মের মতো পরলাম কাইজ্জা আর জাহাঙ্গির এর উপর। ধপাশ করে মাটিতে তিন জনই লুটোপুটি খেলাম। 

হারামজাদা খাস কি তুই ? দেখতে হ্যাংলা পাতলা। ওজন কত রে মামা ? মনে হয় দুই নাম্বার বাস টা আমার উপর আইসা পরছে । 

কাইজ্জা থাম কি শুরু করছোস?
না আপনারে কিছু বলা যাবে না উনি ... হয়েছেন । ( বাংলায় অনুবাদ করতে পারছিনা বলে দুঃখিত) হালায় কচু খাইয়া হাতির মতো শরীর বানাইছে । 
জাহাঙ্গির এই রকম করলে আর স্কুল পালাবো না । 

চল এইখান থেকে , স্যার টের পাইলে লুকোচুরি খেলা বেড় করবে । আমরা চললাম খাল পারের সৌন্দয্য কে উপভোগ করতে । জাহাঙ্গির ক্যাপ্টেন হলেও ক্লাস ফাকি দেয়ার ব্যাপারে ওর উৎসাহ একটু বেশি ছিল । লেকের কাছে চলতো গান , কার কালেকশনে কি কি গল্প আছে সবাই শেয়ার করতো , সেগুলি ভদ্র সমাজে বলে পরিবেশ নষ্ট করার কোন ইচ্ছে আমার নেই , আমি না পারতাম গান গাইতে না পারতাম গল্প বলতে , শুধু পাসে বসে গল্প শুনতাম , দেখতে তেমন ভালো না হওয়ায় কোন মেয়ের শুভ দৃষ্টি আমার উপর কখনোই পরে নাই , আফসোস করতে করতেই দিন শেষ হয় । প্রেম তো হলই না এমনকি ছ্যাকা খেলেও বলতে পারতাম আমি ফূটবলে পা লাগাতে না পারলে কি হবে খেলতে তো নেমেছিলাম !!!


সবাই তাদের প্রেমের গল্প বলতে শুরু করতো ,আমি শুধুই শুনে যেতাম । একদিন দেখলাম আমাকে নিয়েও ফান করা শুরু করেছে , হায় রে এই ছিল কপালে? আমার মত বোকা মানুষ কে নিয়েও স্ক্যান্ডাল !!! প্রতিদিন কাউরে না কাউরে নিয়েই নতুন নতুন গল্প সৃষ্টি হতো । এইভাবেই বিকেল হয়ে যেতো , আমরা ঘরে ফিরতাম । পরের দিন কেয়ামত নাজিল হতো। মহসিন স্যার এর চিৎকারে যত না ভয় পেতাম তারচেয়ে বেশি লজ্জা পেতাম। চোখ ছল ছল করে উঠতো। সারা দিন চুপ হয়ে থাকতাম । আবার আমারে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো গুরুজি জাহাঙ্গির । 

স্যার যখন আমাদের বকতে শুরু করবে তুই সেই সময় ভাব্বি তুই বিচে তোর জিএফ কে নিয়ে বেড়াতে গেছোস। চোখের দিকে তাকিয়ে গান গাচ্ছিস। ব্লা ব্লা ......... তারপর দেখবি স্যার কি বল্ল টেরই পাবি না । 

স্কুল পালানোর ব্যাপার এক সময় নিয়মিত হতে থাকলো , আমাদের ক্লাস টিচার মহসিন স্যার এর একটা কমোন শাস্তি ছিল পুরো ক্লাস কে কান ধরে বেঞ্চে দাড়িয়ে করিয়ে রাখা । প্রথম দিকে লজ্জা লাগলেও বেঞ্চে ঊঠে দাড়াতে দাড়াতে এক সময় অভ্যাসে পরিনত হয়ে যায়।। ক্লাস পালিয়ে পরের দিন স্যার আসার আগেই আমরা বেঞ্চে উঠে দাড়াতাম। এখন আর লজ্জা শরম বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই tongue emoticon আমি অনেকটাই নির্লজ্জের দলে ভেসে গিয়েছি।
কিরে নইম্যা তুই কান ধরে বেঞ্চে উঠে দাড়াস তোর লজ্জা লাগে না ? 
তুই ক্যাপ্টেন হয়ে বেঞ্চে হাতির মতো কান দুই টা ধরে রাখোস তোর লজ্জা লাগে না grin emoticon 
দেখ না রাসেইলা কেমনে কান ধরে tongue emoticon 
কোন কারনে মহসিন স্যার ক্লাস থেকে বেড় হলে এই অবস্থাতেই শুরু হতো গান। কানে ধরতে যে এত মজা আগে কে জানতো ? 
কান ধরে দাঁড়িয়ে তিন তলার দিকে ভালো করে তাকানো যেতো বলে আমরা অতি উৎসাহ নিয়ে মহৎ কাজে মনোনিবেশ করতাম । এইভাবে রেগুলার পুরো ক্লাস বর্জনের ফলে স্যারের উপর চাপ বাড়তে থাকে, সেই চাপ পরে আমাদের উপর ,স্যার বুঝতে পারে এই গুলি বদের হাড্ডি। এই গুলিরে এইভাবে শাস্তি দিয়ে কোন লাভ নেই। শাস্তির পরিমান আরো বেড়ে যায়, এখন কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়ানোর সাথে যোগ হলো কলম বেত এর স্পর্শ , আমরা আবার একটু বেহায়া ছিলাম মার খেয়েও শিক্ষা হয়নি , এই ক্লাস বয়কট চলতে থাকে সপ্তাহে দুই/তিন দিন। মহসিন স্যার এইবার আমাদের ক্লাস পালাবোনা স্বীকারোক্তি নিয়ে সবার সাদা কাগজে সিগনেচার নিলেন, কেউ এর পর থেকে ক্লাস পালালে টিসি দেয়া হবে বলে হুসিয়ারি দিলেন। এইবার আমরা অনেক ভয় পেলাম। স্যারের ছেলে হিরু আমাদের সাথেই পরতো। ও আমাদের অভয় দিল পালাতে চাইলে আমি তোদের সাথেই আছি , আমরা ভাবলাম স্যার তো আর নিজের ছেলেকে টিসি দিবে না তাহলে আমরাও বেঁচে যাবো , আবার পালালো নির্লজ্জের দল ।
পরের দিন ক্লাসে ঢুকেই আমি বেঞ্চে উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে জাহাঙ্গির ও উঠলো , স্যার কিছু বলার আগেই পুরো ক্লাস কান ধরে বেঞ্চের উপর উঠে দাঁড়িয়েছে ,স্যার আমাদের উচ্চবংশীয় ভদ্রলোক বলে বকা দেয়া শুরু করেছে ,আমরা কোন দিন এই কথা গুলির পাত্তাও দেইনি এইটা স্যার ভালো করে জানে । হটাত করে স্যার একটু বাহিরে গেলো । শুরু হয়ে যায় আমাদের বাঁদরামি । কাইজ্জা ইন্ডিয়ান নায়িকাদের কপি করে নাচতে শুরু করলো grin emoticon তারপর ক্লাসে কি অবস্থা হয় কল্পনা করাও কঠিন । আমাদের ক্লাসের দিকে ৪/৫ টা মেয়ে আসতে শুরু করেছে ।
গল্পের প্রয়োজনে এদের অরিজিনাল নাম বলতে পারছিনা বলে দুঃখিত । কি নাম দেয়া যায় ? এদের নাম হতে পারে পরীমনি , জয়া কিংবা শাবনুর। 
ওরে কি সৌভাগ্য পরিমনি আজ এত কাছে আসছে উফফফফফ কাইজ্জা স্বভাব সুলভ দুষ্টামি শুরু করে দিয়েছে । 
যা তুই আর নইম্মা পরীমনি রে নিয়ে থাক শাবনুরের দিকে চোখ দিলে চোখ কইলাম উপড়ে ফেলমু 
এহহহ শাবনুর মনে হয় ওনার রেজিষ্ট্রি করা ?রাসেল একটু চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে tongue emoticon 
কথা বলতে বলতেই মহসিন স্যার সহ ড্রিম গার্লরা ঢুকল । 
আল্লাহ গো এ কি শুরু হলো? মেয়েদের সামনে আমরা কানে ধরে আছি এই দৃশ্য দেখার আগে আমাদের মরন হলো না কেন ? 
মনে মনে বলছি আল্লাহ যদি সাত আসমানে আমাকে তুলে নিয়ে যেতো বেঁচে যেতাম frown emoticon 
স্যার এর হোম ওয়ার্কের কপি দিয়ে মুখ লুকিয়েছি একটু পর দেখি পুরো ক্লাস এই কাজ করা শুরু করেছে , এই ৪/৫ টা মেয়ে দেখতে পরীর মতো সুন্দর । কিন্তু দেখতে আজ এত জঘন্য লাগছে কেন ? এরা কি ভাব্বে ? 
স্যার দেখছিস গরুর দল গুলির কি অবস্থা ? 
আমাকে বলে আরে নমি কি হয়েছে ? পড়া শিখিস নাই ? ওমা জাহাঙ্গির তোর ও দেখি এই হাল !!
হি হি করে হেসে দিলো ।
একটা ছবি তুলে রাখতে পারলে সেই রকম মজা করা যেতো হিহিহি... 
মনে হয় এই মেয়েরা একেকটা আইনস্টাইন ,কোন দিন অপরাধ করেনাই আমরা মাইঙ্কা চিপায় পরছি বলে আমাদের সাথে এই রকম করছে ।এক একটার যেই রেজাল্ট grin emoticon 
স্যার আমাদের বলে এই যে ভদ্র ছেলের দল মুখ লুকাচ্ছিস ক্যান , ক্লাস পালানোর সময় মনে ছিল না ? জীবনে অনেক স্টুডেন্ট দেখেছি কিন্তু তোদের মতো ইতর , নির্লজ্জ ,বেহায়া ছেলে একটাও দেখি নি, এর পর পুরো স্কুল কম্পাউন্ড তোদের কান ধরে ঘুরাবো বলেও হুশিয়ারি দিয়েছিল ,এক সময় ক্লাস শেষ হয়ে যায় , লজ্জায় অপমানে কারো সাথে কথা বলতে পারি নাই । প্রায় দিন দশেক আর ক্লাস পালাই নাই ,স্যার ভেবেছে ঔষধে কাজ হয়েছে ।
ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গির আবার বলে বসে অনেক দিন ক্লাস পালাইনি , কেমন জানি শরীরটা নিসপিস করছে , গুরুজি বলেছে আমরা কি অবাধ্য হতে পারি? কথা টা শেষ না হতেই আবার প্ল্যান শুরু হয় কিভাবে ক্লাস পালাবো ,
“কয়লা ধুলে ময়লা যায় না,
কুত্তার লেজ ১২ বছর চুঙ্গার মধ্যে রাখলেও সোজা হয়না ” 
এই রকম কত অসাধারন বানী আমাদের শুনতে হয়েছে কিন্তু টিফিনের পর ক্লাস ফাকি দেয়া আমরা ছাড়তে পারিনি ।এইভাবেই স্কুল লাইফ শেষ হয় ।স্কুল লাইফ শেষ হয়ে যাবার সাথে সাথে স্মৃতির পাতায় ঠাই নেয় কানে ধরার গল্প ।কয়েক বছর আগে আমি স্কুলের রিইউনিয়নে যোগ দিতে চট্টগ্রামে গিয়েছি ,আমাদের সব বন্ধুদের সাথে দেখা হয়েছে , দেখা হয়েছে সব টিচারদের সাথে। স্যার কে আমাদের এক বন্ধু বলেই বসে স্যার একবার কান ধরাবেন না, স্যার হেসে শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আমাদের , স্যারের কঠিন চেহারা যেমন দেখেছি তেমনি কোমল স্পর্শে হৃদয় ছুয়ে গিয়েছে কানে ধরার দলের ।আমি টঙ্গি চলে আসার পর সবার সাথে নিয়মিত দেখা হয়না কিন্তু যখনই দেখা হয় আমরা ফিরে যাই সেই স্কুল লাইফে , যেভাবে গান গাইতো সবাই ,গল্প বলতো ঠিক সেভাবে ।

No comments:

Post a Comment