আমাদের কলোনিতে এমন কিছু পরিচিত মানুষ ছিল যারা কোনভাবেই স্টিলমিলের সাথে জড়িত না অথচ ছিল আমাদের বড় আপনজন। আমরা নিজেরাও জানিনা কবে কিভাবে তারা আমাদের কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছিলো। সেইসব দুচারজন মানুষ নিয়ে এই ফিচার। এরকম আরো কয়েকজন হয়তো আছে যা আমার জানা নেই।
সুজাউদ্দিন (প্রকাশ সুজি): সেই কবে নোয়াখালীর কোন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসে সাগর পাড়ের স্টিলমিল কলোনিতে জীবিকার সন্ধান পেয়েছিলেন সুজাউদ্দিন। কলোনিতে সবাই তাকে চিনতো সুজি নামে। একটা কাজই জানতেন- নারকেল গাছের রক্ষণাবেক্ষণ। সেই থেকে কলোনিতে। শেষের দিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে খলিল নামের একজনের আগমন ঘটেছিলো তবে অত্যধিক চতুর প্রকৃতির হওয়ায় কলোনিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি খলিল। সহজ সরল সুজাউদ্দিন কথা একটু বেশি বলতেন আর কথার পুনরাবৃত্তি করতেন খুব।
নোয়াখালীর খাস আঞ্চলিক ভাষা ছাড়া কথা বলতে পারতেন না। কলোনির মোটামুটি প্রতিটা বাসা ও প্রতিটা নারকেল গাছে তার পদচারনা ছিলো। কলোনির কয়েক হাজার নারকেল গাছ আলাদা ভাবে তিনি চিনতেন এবং কোন গাছে কি সমস্যা, কবে পরিস্কার করতে হবে তার মুখস্ত ছিলো। সুজাউদ্দিন চা পান করতে পছন্দ করতেন। আমার মনে আছে, নারকেল গাছে উঠার আগে আম্মাকে চায়ের ফরমায়েশ দিয়ে যেতেন। গাছ থেকে নেমে খাবেন। উনি আবার অত্যন্ত বিবেচক ছিলেন- চায়ের ফরমায়েশ দিয়েই তার মনে হতো এই বাসায় হয়তো চা পাতা নেই তাই সঙ্গে সঙ্গে তিনি কয়েক হাজার বার বলতেন "ন থাইকলে থাক" অর্থাৎ একান্তই যদি না থাকে তাহলে তিনি চা এর দাবী ছেড়ে দিচ্ছেন।
কলোনির যত কাক সব সুজাউদ্দিনকে চিনত। সুজা যেদিকেই যেতেন মাথার উপর দুচারটা কাক কা কা করতে করতে ঘুরপাক খেতো। আমার ধারনা কাক জননীরা কাক শিশুদের সুজাউদ্দিনের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতো। গাছ থেকে নামার সময় তিনি সবসময় কাকদের বড় বোনদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে করতে নামতেন। নামার পর দেখা যেতো তার ত্যাদড় শ্যালক শ্যালিকারা দুলাভাইয়ের মাথা ঠুকরে দিয়েছে। আমরা এটাকে তেমন পাত্তা দিতাম না। শালা দুলাভাইয়ের রঙ্গ তামাশা হিসেবে উড়িয়ে দিতাম। আমরা উড়িয়ে দিলেও জনাব সুজাউদ্দিন তার নাম বিকৃত করে ডাকা চূড়ান্ত অপছন্দ করতেন। উচ্চারণগত সাদৃশ্যের কারনে সুজা একসময় হয়ে গেলো সুজি আর আমাদের সুজাউদ্দিন গাছ থেকে দা ছুঁড়ে মেরে আজীবন প্রতিবাদ করে গেছেন বাপ মায়ের দেয়া নামের এমন বিকৃতির।
বেলাল ভাইঃ বেলাল ভাই এসেছিলেন নওগাঁ থেকে। গ্রামঃ বদলগাছি, পোস্টঅফিসঃ বদলগাছি, থানাঃ বদলগাছি, জেলা নওগাঁ। হাড়জিরজিরে একটা ছেলে একদিন কাজের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের কলোনিতে এসে হাজির। কাজও জুটে গেলো একটা ওয়াকার্স ক্লাবের পাশের রাস্তার বিপরীতের দোকানে (দোকানটা পরে ওয়াকার্স ক্লাবের পাশে চলে গিয়েছিলো) । দেখা গেলো দোকান পরিচালনায় তার ইশ্বর প্রদত্ত প্রতিভা আছে। ওই দোকান ছেড়ে পরে কাজ নিলেন স্টিলমিল বাজারের ইসলামের দোকানে। সেখান থেকে ভাই ভাই স্টোরে। এখানে দীর্ঘদিন ছিলেন। এরপর সর্বশেষ ছিলেন সালাহউদ্দিন ভাইদের দোকানে। খেলাধুলার প্রতি বেলাল ভাইয়ের দুর্নিবার আগ্রহ ছিল।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হবার পর বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বেলাল ভাইয়ের দৌড় এখনো আমার চোখে ভাসে। সেদিন পতাকা হাতে বেলাল ভাইকেই পুরো বাংলাদেশের প্রতিনিধি মনে হচ্ছিলো। বেলাল ভাই ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আমাদের বাসায় প্রতিদিন দুপুরে ঘুমাতে আসতেন। বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে যাওয়া সুখী মানুষ না হলে সম্ভব না। বেলাল ভাইয়ের সম্পূর্ণ ঠিকানা আমি জানি কারন বেলাল ভাইয়ের কতো অসংখ্য চিঠি যে আমি লিখে দিয়েছি তার হিসেব নেই। সেসব চিঠিতে বৈষয়িক কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে কি প্রগাঢ় মমতা যে লুকিয়ে থাকতো। আমি মাঝে মাঝে বেলাল ভাইকে না জানিয়ে নিজে থেকে দুয়েকটা লাইন ঢুকিয়ে দিতাম। বেলাল ভাই এখন সউদি আরব আছেন। যতদূর শুনেছি বেশ ভালো অবস্থায় আছেন। আমি নিশ্চিত তিনি দেশে থাকলে আমাদের মহাআড্ডার কথা শুনে চুপ করে থাকতে পারতেন না।
আহমেদ ভাই, মোখলেস ভাইঃ এই দুজন অফিসার্স ক্লাবে কাজ করতেন। এদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানিনা আমি। আহমেদ ভাই ছিলেন দুঃখী দুঃখী চেহারার চিরদুঃখী একজন মানুষ। মোখলেস ভাই ছিলেন আহমেদ ভাইয়ের তুলনায় কিছুটা চতুর স্বভাবের। দুজনই অফিসার্স ক্লাবের দেখাশুনা করতেন। আমরা কখনোই তাদের পরিবার পরিজনের খবর নেইনি।
No comments:
Post a Comment