পৃথিবীতে সাতশ কোটি মানুষের বাস। জাতি, ধর্ম, বর্ন, চেহারা, জাতীয়তা, পরিবার, ব্যাক্তি, স্বভাব ভেদে প্রতিটা মানুষ আলাদা। পৃথিবীর এক প্রান্তে যে সাধু মানুষকে আলো দেখাচ্ছে দেখা যাবে আরেক প্রান্তে একই চেহারার ব্যাক্তি মানুষ জবাই করে এসে বোরহানী দিয়ে হাজির বিরিয়ানী খাচ্ছে। চরম বৈপরীত্য মানুষের মাঝে থাকেই। কিন্তু যখন একদল মানুষ একই পরিবেশে, একই পরিবার কাঠামোর মধ্যে আর একই শিক্ষা ব্যবস্থায় বেড়ে উঠে তখন খুব সহজেই বলা যায় তাদের মৌলিক মানসিক কাঠামো একরকম হবে। আমি খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি স্টিলমিল কলোনির প্রতিটা মানুষ খুব কাছাকাছি মানসিকতায় তৈরি। উদাহরন দেই- আমরা তখন কলোনিতে ঢুকেছি মাত্র।
১৯৮৭ সালের কথা। আমার পায়ে প্লাস্টার। কলোনির বাইরের বাসায় থাকতেই টারজান খেলতে গিয়ে পায়ের গিরা নল্লি ভেঙ্গে ফেলেছিলাম। কলোনিতে ঢুকেছি উরু পর্যন্ত প্লাস্টার নিয়ে। এই আমার এক বদঅভ্যাস, ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া শুরু করেছি। যাই হোক, ভাঙ্গা পায়ের কারনে বাসা থেকে বের হতে পারিনা তাই দুপুরে একা একা বারান্দায় বসে ক্যারম খেলছিলাম। হঠাৎ ধুপ করে একটা শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। সেদিন মনে হয় ছুটির দিন ছিলো। আব্বা বাসায়। আব্বাকে দেখলাম হুড়মুড় করে বাসা থেকে বের হয়ে কাকে যেন কোলে নিয়ে পাগলের মতো দৌড়। আব্বার খালি গা, লুঙ্গি পরা। রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো আব্বার শরীর আর লুঙ্গি। জানলাম দোতালার ফাতেমা তিনতলার কার্নিশ থেকে বেলী ফুল পাড়তে গিয়ে পড়ে গেছে। মানসিকতার মিলটা বলি- আব্বার খালি গায়ে চাষার মতো দৌড়ে যাওয়া কেউ একজনের ঠিকই চোখে পড়েছে। সে বাসা থেকে আব্বার একটা শার্ট খুঁজে নিয়ে আব্বার পিছে পিছে দৌড়।
কলোনির মানুষের সহনশীলতাও ছিলো মানবিক মাপকাঠিতে অনেক উঁচু। আবারো উদাহরন দিতে হচ্ছে- ১৯৯১ এর ২৯ এপ্রিলের জলোচ্ছাস। (আমার কথায়, লেখায় বারবার এই দিনটা চলে আসে। আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন এটি। অনেককিছু শিখেছি আমি এই দিনের পর থেকে।) জলোচ্ছাসের পানিতে ভেসে এসে একটা গাভী আশ্রয় নিলো মক্তবের সাথের ই-টাইপের বিল্ডিঙের সিড়িতে (বিল্ডিঙের নাম্বার মনে করতে পারছিনা)। ৩০ এপ্রিল দুপুরে গাভীটি একটি বাছুর প্রসব করলো সিড়ির নিচেই। এমনিতেই গর্ভবতী তার উপর জলচ্ছাসের এমন রুদ্র রুপের সাথে সারারাত যুদ্ধ করে হিংস্র হয়ে উঠেছিলো পশুটি। বাচ্চা প্রসবের পর তার হিংস্রতার মাত্রা আরো এক কাঠি বাড়লো।
ওই সিড়ির আশেপাশে তো বটেই এমনকি ওই বিল্ডিঙের আশেপাশে কাউকে ঘেষতে দিচ্ছিল না সে। গাভীটি তিনদিন বাচ্চা নিয়ে ওই সিঁড়ির নিচে ছিলো। হেন অত্যাচার নেই সে করেনি। তবু একটা মানুষও কখনো বলেনি সদ্যপ্রসুত বাচ্চাসহ গাভীটি সরিয়ে দিতে। কলোনির মানুষ নিজেদের অসুবিধার উর্ধে উঠে সদ্যভুমিষ্ঠ গো-শাবকটিকে মানবিক দিক থেকে দেখেছে। একটি বিপদগ্রস্থ পশুর প্রতি তাদের যে মমতা একটি বিপদগ্রস্থ মানুষের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
২৯ জানুয়ারির অনুষ্ঠান নিয়ে কিছু বলি। ব্যাক্তিগত মনোমালিন্য কিছু থাকবেই। না থাকলেই বরং তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কিছুদিন ধরে কিছু ফিসফিস, কানাকানি, হুড়োহুড়ি দেখা যাচ্ছে। অপরিপক্ব বিদ্বেষসূচক কিছু লেখাও দেখেছি। আমার মনে হয়না যে এসব নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু আছে। শেষমুহুর্তে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঐতিহ্য ষ্টিলারদের আছে। ২৯ জানুয়ারির অনুষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এমন মতবিরোধ যদি কারো মধ্যে থাকে সেটা মিটিয়ে ফেলার মতো সৎসাহসও তাদের মধ্যে থাকা উচিত। আমি মনেপ্রানে বিশ্বাস করি পেছন থেকে ছুরি চালানোর মতো কাপুরুষ এই কলোনিতে কখনো জন্ম নেয়নি। নির্দ্বিধায় সামনে তাকিয়ে কাজ করে যেতে পারি আমরা।
No comments:
Post a Comment