আজ সকালে অফিসে যাওয়ার পথে বাসে বসে আছি, দশ নাম্বারে কঠিন গিট্টু লেগে আছে। হকারদের পন্য বিকিকিনির মচ্ছব লেগে গেছে। কত আজব রকম জিনিস যে বিক্রি হতে পারে আর কত আজব ভাষায় যে বিক্রির প্রচারনা চলতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। সুগন্ধি কলম, যষ্ঠিমধু, ডিজিটাল তসবি, খোয়াবনামা, রুমাল, জায়নামাজ সবই পাওয়া যাচ্ছে হকারদের কাছে। গাড়িতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় সংবাদপত্র। কি জানি কেন পেপার বিক্রেতা হকার সবই বাচ্চা। ৬/৭ বছর বয়স ওদের। নরম ছোট ছোট হাত, তুলতুলে আঙুল।
বাচ্চাগুলো চলন্ত বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে যখন দৌড় শুরু করে আমার ভয় লাগে এই বুঝি পড়ে গেলো। প্রতিদিন আমার একই আতংক। কিছু বাসযাত্রী আছে খবিসের চূড়ান্ত। সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পেপার কিনে কিন্তু আগে টাকা দেয় না। পেপার হাতে নিয়ে এরপর বড় নোট দেখিয়ে বলে ভাংতি বের কর। ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করে আর বাচ্চাটা টাকা গুনতে গুনতে দৌড়াতে থাকে গাড়ির পিছন পিছন। কষ্টে আমার চোখে পানি চলে আসে। ভালো লোকও আছে। একদিন এরকম এক লোক এক বাচ্চা হকারের কাছে পেপার চাইলো কিন্তু তার আগেই বাস ছেড়ে দিয়েছে। বাচ্চাটা কাস্টোমার হাতছাড়া না করার জন্য প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলো।
ওই লোক এটা দেখে জানালা দিয়ে মাথা বের করে চিৎকার করা শুরু করলো "দৌড়াইস না বাপ, এই নে টেকা। পেপার লাগবো না। লোকটা সত্যিই একটা পাঁচ টাকার নোট ফেলে দিলো জানালা দিয়ে। গাড়িটা যখন সিগন্যাল পার হয়ে রাস্তার আরেক প্রান্তে গিয়ে যাত্রি তুলছিলো বাচ্চা হকার ঠিকই এতদূর দৌড়ে এসে ওই লোকের হাতে পেপার দিয়ে গিয়েছে। কি ছোট ছোট নিস্পাপ বাচ্চা একেকটা। ছোট ছোট আঙুল। এক হাতে পেপারের বান্ডেল আর অন্য ছোট নরম হাতে চলন্ত বাসের হেন্ডেল ধরে বাসে উঠে রিনরিনে গলায় বলে "আমাদের সময় ১২ পৃষ্ঠা মাত্র ৫ টাকা"।
আমার বড় কষ্ট হয়। ইচ্ছে করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলি তোমাদের সময় মাত্র ৫ টাকা নারে বাপ। মাত্র ১২ পৃষ্ঠাও নয়। তোমাদের সময় অমূল্য। তোমাদের সময় মহাকাব্যের চেয়ে বড়। যাদের সময় মাত্র ৫ টাকা তারা অনায়াসে বেঁচে থাকে আর এই বাচ্চাগুলো একদিন বাসের হেন্ডেল ফসকে গাড়ির নিচে মরে পড়ে থাকে। যেন ১২ পৃষ্ঠাতেই ওদের জীবন সীমাবদ্ধ।
ইশ, এমন কিছু যদি করতে পারতাম যাতে ওদের ১২ পৃষ্ঠার সীমিত জীবন মহাকাব্য হয়ে উঠে, যেন ওদের সময়গুলো, স্বপ্নগুলো মাত্র পাঁচ টাকায় বিক্রি হয়ে না যায়।
No comments:
Post a Comment