Tuesday, February 16, 2016

পেনসিলে আঁকা পরী (একটি নির্লজ্জ ব্যক্তিগত কথাকাব্য)



যদিও ভ্যালেন্টাইন চলে গেছে। তবু কিছুটা রেশ তো থেকেই যায়। আজ মনে হচ্ছে এতো বছর পর পরীর কথা একটু বলাই যায়। পরীকে নিয়ে দুটি কবিতা লিখেছিলাম "পেনসিলে আঁকা পরী" নামেই। । সেই ২০০৮ সালের কথা। আমি পাড় বেকার। পুরো পরিবার ঢাকায় চলে এসেছি। আমার জন্য বীভৎস সময় সেটা। বন্ধুবান্ধব সব চট্টগ্রামে ফেলে এসেছি। ঢাকায় আমার অস্থির সময় কাটছে। কিছুই ভালো লাগেনা। ইন্টারনেটের কল্যানে কিছু বন্ধু ছিলো ঢাকায়, তাদের সাথে যোগাযোগ করলাম। ধীরে ধীরে অল্পস্বল্প আড্ডাবাজি শুরু হলো। চপল, শার্লি, রনি এই তিনজনের সাথে দিনের পর আড্ডা দিয়েছি টিএসসিতে। কারো পকেটেই টাকা থাকতো না। সবাই বেকার। বাস ভাড়া থাকলেই আমি আর চিন্তা করতাম না, আড্ডায় ছুটতাম। চপল তখন এমবিএ শেষ করেছে, চাকরি খুঁজছে। শার্লি শরিয়তপুরের মেয়ে, ঢাকায় একা থাকে। রনি পড়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কেমিস্ট্রি নিয়ে। 


আড্ডা দিতে দিতে কখন যে রাত এগারোটা বেজে যেতো টেরই পেতাম না। আমি টিএসসি থেকে শাহবাগ হেঁটে যেতাম বাস ধরার জন্য। সোডিয়াম আলোয় হলুদ হয়ে যাওয়া বিষন্ন নির্জন রাস্তা। মাঝে মাঝে মনটা এতো খারাপ হয়ে যেতো, কান্না পেতো খুব। এর মধ্যে চপল প্রাইম ব্যাংকে ইন্টার্নশীপ পেয়ে গেলো, রনি তার পড়ালেখা নিয়ে অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রইলাম আমি আর শার্লি। আগের মতোই টিএসসি তে আড্ডা দিয়ে রাতে ফিরি। রাত বেশি হলে শার্লিকে তার লক্ষীবাজারের বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। এভাবেই চলছিলো। একদিন হুট করে শার্লি বিয়ে করে ফেলল, সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো একদম। এর সপ্তাহখানেকের মাথায় আমি ছোট একটা অফিসে একটা ছোট চাকরিতে ঢুকে পড়লাম। ছোট গোছনো অফিস। পুরান ঢাকার পাঁচ বন্ধু মিলে একটা জায়গা কিনেছে সেই জায়গাতে দালান হবে। সেই দালানের ঘর বিক্রি করে হবে ব্যবসা। 

যতটা না ব্যবসাচিন্তা তার চেয়ে বেশি ছিলো তাদের স্বপ্ন। আমিও তাদের স্বপ্নে শরিক হয়ে গেলাম। আমার কোন কাজ নেই। সারাদিন বসে থাকি আর কেউ কিস্তির টাকা এনে দিলে ড্রয়ারে রেখে দেই। অফিসে বসে মোবাইলে সারাদিন চ্যাট করি। সকাল দশটায় ঢুকি আর বিকেল হলেই বের হয়ে যাই। জিন্দাবাহার লেন থেকে হেঁটে হেঁটে গুলিস্থান চলে যাই। কানে ইয়ারফোন লাগানো থাকে আর অবিরাম বাজতে থাকে একটাই গান-
Hey ! Mr Tambourine Man, play a song for me
I'm not sleepy and there is no place I'm going to
হ্যা আমার কোথাও যাবার জায়গা ছিলোনা, একটু আশ্রয় ছিলোনা আমার।

ঢাকাইয়াদের সবকিছুতেই ফুর্তি ফুর্তি ভাব। একদিন আমি বললাম কম্পিউটার লাগবে। সবাই একসাথে টুপটাপ করে আকাশ থেকে পড়লো-
জাবেদ ছাব আপনে এতদিন কম্পুটার ছাড়া কাম করবার লাগছেন কেমতে? আগে কইলেন না কেলা? 
অফিসের পিয়নের নাম শিবলু। আমার সাথে অতি মধুর সম্পর্ক। একসাথে বসে সিগারেট খাই, সে খায় বেনসন সিগারেট, আমার ব্রান্ড গোল্ডলীফ। (শিবলুর নিজের পাকা বাড়ি আছে পুরান ঢাকার মত জায়গায়) সে প্রায়ই অনুযোগ করে বলে-
দুইডা টেকার লাইগ্যা গোল্ডলীফ খান, গলাত ধাক লাগেনা?
আমি হেসে বলি- না গলায় "ধাক" লাগেনা। দুই টাকা বেশি গেলে বরং মনে "ধাক" লাগে।
শিবলু হেসে গড়াগড়ি খায়। 
জাবেদ ভাই এই পুরা জিন্দাবাহার লেন, ইসলামপুর, পাটুয়াটুলি এরিয়াতে কেউ যদি আপনেরে কিছু কয় খালি আমারে আইয়া কইবেন। 
এবার আমি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাই। 
শিবলু অভিমান করে আমার উপর। এরপর সে তার জীবনের বিস্তর ভায়োলেন্সপুর্ন ঘটনার বর্ননা দেয়া শুরু করে। কারো ঘাড়ে কোপ দিলে কিভাবে ফিনকি দিয়ে "খুন" বের হয় সেটার নিখুঁত বর্ননা সে আমাকে দিয়েছিলো।
কম্পিউটার কেনার আলোচনায় এবার শিবলু যোগ দেয়। প্রথমেই সে ঝাঁঝিয়ে উঠে-
কাম করতে করতে মানুষটার মুখ দিয়া ফেনা বাইর হইতাছে আপনেরা খিয়াল নিবেন না? 
এরপরই ঠিক হয় পরদিন অফিসের জন্য একটি "কম্পুটার" কেনা হবে। আগেই বলেছি ঢাকাইয়াদের সবকিছুতেই ফুর্তি। পরদিন আমরা হইহই করে কম্পিউটার কিনতে রওনা হলাম। কোত্থেকে একটা গাড়ী যোগাড় করে আনা হলো, সেখানে উঠলো চারজন। আমি গেলাম সাইফুল ভাইয়ের সাথে উনার ভাঙ্গা ভেসপা স্কুটারে উঠার জন্য। সেই ভেসপা আবার এক দর্শনীয় বস্তু। সাইফুল ভাইয়ের লোহালক্কড়ের ব্যবসা। সেই লোহালক্কড়ের মাঝে ভেসপা টা দেখে আমি ভাবলাম এটাও বোধহয় স্ক্র্যাপ লোহা। সেটাই দেখি দুজন কর্মচারী ঝেড়েপুছে বের করে আনলো। বিস্ময়করভাবে সাইফুল ভাই ওটা এক কিকেই স্টার্ট করে ফেলল। বিপত্তি বাঁধল এরপর। স্কুটারে উঠতে গিয়ে আমার পায়ে টান পড়লো। আমি আ...আ...আ... করতে করতে নেমে পড়লাম আর দেখি সেই দুই কর্মচারী "পায়ে টানা লাগছে রে......" বলে দৌড়ে এসে আমার পা ধরে টানাটানি করছে। বুঝলাম এই বাহনে উঠতে গিয়ে প্রায়ই "পায়ে টানা লাগছে রে......" ঘটে। সেদিনিই আমরা একটা ঝকঝকে কম্পিউটার কিনে ফিরলাম। আমাদের অফিসের প্রথম কম্পিউটার। সাথে একটা প্রিন্টারও। অফিসের কাজে এটা তেমন সহায়ক হলোনা তবে আমি মোবাইল বাদ দিয়ে পিসিতে চ্যাট করা শুরু করলাম। এর কিছুদিন পর হঠাৎ পরীর সাথে আমার পরিচয়। প্রথমে একটা দুটা কথা। ধীরে ধীরে কথার পরিমান বাড়লো। তার জীবনটা নানান ভাবে জটিলতায় ভরা। আমার জীবনও সহজ নয়। খুব সহজে আমরা কাছাকাছি হলাম। সে তখন মিটফোর্ডে এমবিবিএস ফোর্থ ইয়ারের ছাত্রী। আমার অফিসের পাশেই মিটফোর্ড। একদিন তাঁতিবাজার মোড়ে দেখা করলাম আমরা। আমি তাকে দেখে মুগ্ধ হলাম। ছোট করে ছাঁটা রেশমি চুল, সুন্দর একজোড়া চোখ যেন সারাক্ষণই হাসছে আর যেন শিল্পির তুলিতে আঁকা একজোড়া ঠোঁট। আমরা সারারাত কথা বলতাম। সে বই পড়তে ভালোবাসতো। আমি একদিন তার মন খারাপ শুনে হুমায়ুন আহমেদের বহুব্রীহি কিনে শিবলুকে দিয়ে পাঠালাম তার হোস্টেলে। আরেকবার অন্যদিন ঈদ সংখ্যা কিনে পাঠালাম। সেই বইটি তার হাতে পৌঁছেনি শুনে শিবলু সত্যি সত্যিই হোস্টেলের দারোয়ানকে পিটিয়ে এলো। এটা নিয়ে পরী খুব রাগ হয়েছিলো আমার উপর। পরের এক সপ্তাহ আর আমার সাথে কথা বলেনি সে। তাকে যতই বুঝাই যে মারপিটের ব্যাপারে আমার কোন ভূমিকা নেই সে ততই ক্ষেপে যায়। এর মাসখানেক পর তার সাথে আবার দেখা করলাম সেই তাঁতিবাজার মোড়েই। সে নীলক্ষেত যাবার জন্য রিকশায় উঠলো, আমিও কি ভেবে তার সাথে উঠে বসলাম। রিকশা দোয়েলচত্বর হয়ে টিএসসি তে পৌঁছার পর হঠাৎ পরী আমাকে ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দিয়ে চলে গেলো আর আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমার চেয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো টিএসসি তে আড্ডা দিতে আসা শত শত ছেলে মেয়ে। পরীকে আমি ফেলে দেয়ার কারন অসংখ্যবার জিজ্ঞেস করেছি, সে উত্তর দেয়নি। হেসেছে শুধু। আমাদের মধ্যে যা ছিলো সেটা প্রেম না কোন ভাবেই। আবার সাধারন বন্ধুত্বও নয়। আসলে সম্পর্কটার কোন নাম ছিলো না। হয়তো আমরা দুজন নিজেদের জীবনের জটিলতা ভুলে থাকার জন্যই কাছাকাছি হয়েছিলাম। 
সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাবার মাসখানেক আগে একদিন আমি বাসায় ফিরছি। গাড়ী তখন রাস্তা খালি পেয়ে রোকেয়া স্মরনিতে তুফানের মত ছুটছে। সেসময় পরীর ফোন এলো। আমি গাড়িতে শুনে বলল "এক্ষুনি গাড়ি থেকে নাম"। কিছুতেই তাকে বোঝাতে পারলাম না যে আমি বাসার কাছে চলে এসেছি। অগত্যা সেই তুফান মেইল থামিয়ে আমাকে নামতে হলো। সে তখন র‍্যাংগস ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি উল্টো পথে ওখানে যেতে যেতে সে হেঁটে সংসদ ভবনের দিকে চলে এলো। কিছুতেই তাকে খুঁজে পাচ্ছিনা আমি আর সন্ধ্যার সেই ঘরে ফেরা মানুষের হাজার হাজার গাড়ি থামিয়ে শুধু রাস্তার এপার ওপার করছি। তাকে খুঁজে পেলাম রাস্তার পাশের দাঁতের মাজনের বিশাল এক বিজ্ঞাপন বিলবোর্ডের নিচে। মজার ব্যাপার যেখানে তাঁকে খুঁজে পেয়েছিলাম সেই জায়গায় এখন একটা ডেন্টাল ক্লিনিক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন সে নিজেই একটা সিএনজি ট্যাক্সি ঠিক করে ক্যান্টনমেন্টের জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে তার আর্মি মামার পরিচয় দিয়ে আমাকে নিয়ে ঢুকে পরেছিল। ক্যান্টনমেন্টের সেই নির্জন পথে তার সেদিনের সেই মাত্রাছাড়া পাগলামি ভুলে যাওয়া কখনোই সম্ভব না। 
এর একমাস পর সম্পর্কটা পুরোপুরিই ভেঙ্গে গেলো। আমি প্রস্তুত ছিলাম। জানতাম এমনই হবে। তবুও এরপর ঢাকা শহরে থাকা আমার জন্য একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। এর মাস খানেকের মধ্যে আমি চট্টগ্রামে একটা চাকরি যোগাড় করে চলে গেলাম। আমি ঢাকা ছেড়েছিলাম ২০০৯ সালের ১ এপ্রিল। আবার সেই শহরেই ফিরেছি ২০১৩ সালেই ১৬ সেপ্টেম্বর। সাড়ে চার বছর পর ফিরেও দেখি স্মৃতির ভুত এখনো মাঝে মাঝে এই শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ায়।

No comments:

Post a Comment

Comments

Not using Html Comment Box  yet?

No one has commented yet. Be the first!

rss