Friday, August 28, 2015

আমাদের হক স্যার


গত ১৪ ফেব্রু/১৫ তারিখে আমার টাইম লাইনে হক স্যারকে নিয়ে দু’অংশে স্মৃতি চরণ করে ছিলাম।ভাবলাম কখন কি হয় ততো বলা যায় না ।তাই হুবহু সে দু’অংশকে একত্র করে csm colony পেইজে জমা দিয়ে রাখলাম।
----------------------------------------------------------------------
আমাদের হক স্যার

হঠাৎ করেই বিখ্যাত কিছু ব্যক্তির আত্মজীবনিমূলক বই হাতে এসে পড়লো। বই গুলির পৃষ্টা উল্টাতে উল্টাতে মনে হলো বইয়ের কথাগুলো আগে অনেক বার পড়েছি। কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না । এ সময়ে অকস্মাৎ মনে পড়লো আমদের ষ্টিল মিল হাই স্কুলের হক স্যরের কথা। স্যারের পুরো নাম ছিল ওবায়দুল হক। আমাদের মাঝে স্যারের আরেকটা নাম ছিল—‘কম্বল স্যার’। অনেক দিন আগে—‘আমি তো কম্বল ছাড়িয়া দিয়াছি কিন্তু কম্বল তো আমাকে ছাড়ে না’—প্রসিদ্ধ এ গল্পটি শোনানোর পর তিনিও ‘কম্বল স্যার’ নামে ছাত্রদের মাঝে প্রসিদ্ধ হয়ে যান।স্যার ছিলেন ছোট-খাট শরীরের মানুষ। দারুন ভলিবল খেলতে পারতেন। বাড়ী স্বন্দীপ । সেখানকার আঞ্চলিক টানে কথা বলতেন।অসম্ভব একরোখা,স্পষ্টবাদী,ণীতিবান সাহসী মানুষ।তার মুখ থেকেই শুনে ছিলাম এ সব কথা। তিনি চোখ বন্ধ করে অনর্গল বলে যেতেন ভারত ভাগ, প:পাকিস্থানিদের বৈশম্যমূলক আচরণ, দেশের স্বাধীনতা এবং এর পরবর্তি অবস্থা। সাথে আরো অনেক কিছু।যার আগা মাথা তেমন একটা বুঝতাম না।


তখন ক্লাস এইটে কি নাইনে পড়ি। স্যার আমাদের বাংলা ২য় পত্র নিতেন।ক্লাসে দুষ্ট এবং ফাকিবাজ যে কয়জন ছাত্র ছিল তার মধ্যে আমি একজন। আমাদের প্রিয় বসার জায়গা ছিল পিছনের দিকের বেঞ্চগুলি। স্যারও আমদের ভীষণ পছন্দ(!) করতেন।কারন উঁনি ক্লাসে ঢুকেই পিছনে বসা গুনধরগুলির দিকে একবার চোখ বুলাতেন এ...বং পড়া ধরা শুরু করতেন।বাংলা ব্যকরণ ছিল আমাদের কাছে চরম শত্রুর মত –সমাস,কারক,বিভক্তি কি বিশ্রী গিট্টু দেয়া সুতো রে বাবা !এক নিয়ম ধরে আগাও তো দু’কদম যেতে আরেক চেহারা। কোন প্রকারেই বাগে আনা যায় না। যদিও দু’তিনটা ঠাটা মুখস্ত করে গেলাম।স্যার ভিন্ন পথের আর একখান ধরলেন। ফলাফল(!) স্যার দাঁত ঠোঁট কামড়া-কামড়ি করে এগিয়ে এলেন। তিনি বেত হাতে নেয়া পছন্দ করতেন না। থাবা দিয়ে ঘাড় ধরে, মাথা বেঞ্চের সাথে লাগিয়ে নিলেন। আমরা মাথা টানতাম পিছন দিকে; স্যার টানেন তার দিকে। এর মাঝে স্যার তার ভলিবল পেটানো পাঁকা হাত দিয়ে পিঠের উপর জয় ঢাক বাজাচ্ছেন। যখন ছাড়া পেতাম তখন স্যার হাঁপাচ্ছেন আর আমরা বিচিত্র ভঙ্গিতে পিঠ সোজা করার চেষ্টা করছি। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বলতেন—‘এ্যঁ...এ্যঁ, না বুঝি মুখস্ত মারি আইছে’
স্যারের কাছে সচরাচর কেউ প্রাইভেট পরতে চাইতো না। অবশ্য এ নিয়ে তাঁর কোন আফসোসও ছিল না। বরং কদাচিৎ কেউ পড়তে চাইলে তিনি ছোট ছোট চোখ যথাসম্ভব বড় করে বিশাল আকারের একটা ‘কি’ উচ্চারন করে---‘ক্লাসে হড়াই(পড়াই) ন ?’ বলে ধমকে উঠতেন। তখন অবশ্য ছাত্রদের এখনকার মত এমন মহামারি মার্কা মহাজ্ঞানী বাননোর শিক্ষনীতিও ছিল না আর কোচিং কোচিং স্যালাইনও ছাত্রদের দেয়ার প্রয়োজন হতো না।

নিতান্তই যদি তিনি কাউকে পড়াতেন। তবে সে ছাত্রের কাছ থেকে পড়া আদায়ের ক্ষেত্রে ভীষণ যত্ন নিতেন।একটা উদাহারণ দেই---আমাদের এক ক্লাস জুনিয়ার সালাউদ্দিন।বাড়ী ঢাকা। সেই ধরনের ছাত্র! তার বাবা খোঁজ-খবর নিয়ে সালাউদ্দিনকে সোজা করার জন্য স্যারের বাসায় পাঠান। একদিন খেলার মাঠে দেখি সালউদ্দিনের চোখের কোনায় নীলচে ফুলা দাগ। জিজ্ঞেস করতেই সালাইদ্দিন দু:খিত গলায় জানালো—‘কম্বল স্যার ঘুষি মারছে। দূর, স্যার কিচ্ছু মানেনা ভাবির সামনে মারে তো মারে,পারে তো কুস্তী করে পিটাইতে চায়’।অথচ এ ছাত্রই বছর শেষে রির্পোট কার্ড হাতে, হাসতে হাসতে বলছে—‘স্যারের কিলানি না খাইলে পাশ করতে পারতাম না’। (চলবে)

আমাদের উপর স্যারের নজরদারি এবং আদর- যত্নের কথা শুনে হয়তো ভাবছেন তিনি বোধহয় কঠিন মনের মানুষ ছিলেন। এটা ভাবলে ভুল হবে।তিনি আমাদের ঠেংগাতেন হাসতে হাসতে আর মজার মজার সব ডায়লগ বলতেন।যে ঠেংগানি খাচ্ছে সে ছাড়া বাকি সবাই হাসছে।যেমন স্যার আমাদের পিঠের উপর তবলার বোল তুলছেন আর মুখে ক্লাশিক্যাল রিদমে বলে যাচ্ছেন—‘এ...রে আই(আমি)কিত্ তাম (কি করবো)কিসমতে করি মাইর লই আইছ।সেটা খাইতে হইব-ই’।আবার কখনো কখনো তিনি তার ছোট বেলার দুষ্টামির গল্প শোনাতেন ।যা আমাদের করা দুষ্টামি সে সবের কাছে নিতান্তই শিশু মনে হতো।

ক্লাস টেইনে উঠার পর স্যারের কথায় টনক নড়লো। সামনে এসএসসি পরীক্ষা ব্যাকরণ না বুঝলে কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না। ব্যাকরণের অন্য বিষয় গুলিতো যেমন তেমন, গোল বাঁধল সমাস নিয়ে। এ ব্যাপারে স্যারের বিখ্যাত উক্তি—‘সমাস শিখতে ছ’মাস লাগে’।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই, সেই ছয় মাসকে তিনি ২০/২৫ দিনের ভিতর এনে ছাড়লেন।বাকিটা বললেন সমাস করার আগে একবার করে সজ্ঞা পড়ে নিবি।ব্যাস ধীরে ধীরে সব পরিস্কার হয়ে এলো।
পরীক্ষার খাতায় নাম্বার দেয়ার ব্যাপারে তার মত এমন কৃপন এবং কঠীন হৃদয়ের শিক্ষক স্কুল তো স্কুল, সারা বিশ্বে দু’টি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তিনি এক নাম্বার, এমন কি আধা নাম্বারের জন্যও আমাদের ফেল করাতেন।রির্পোট কার্ডে লিখা থাকতো বাংলা ২য় পত্র সাড়ে বত্রিশ।ক্লাশের ভাল ভাল ছাত্ররাও ৪০/৪৫ নাম্বারের বেশী উঠাতে পারতো কিনা সন্দেহ। দু’এক বার সাহস করে বলেছি---‘স্যার, আধা নাম্বার এক নাম্বার দিলে কি হয়’। স্যারের জবাব—‘এটা কি আঁর(আমার) হকিটের(পকেটের) হুইসা(পয়সা)?চাইলা আর ভিক্ষা দি, দিলাম।খাতায় লেখা না থাইকলে তোরে বানাই নম্বর দিমু নি'?

তিনি ধর্ম নিয়ে ভন্ডামী একদম পছন্দ করতেন না। তার কথা হল ধর্ম কি দেখানোর জিনিস না’কি। অথচ তাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে দেখেছি।আবার কখনও কখনও হুজুরদের ভুল পড়া সুরা কেরাত নিয়ে সমালোচনা করতেন। আরবি ভাষায় তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল বলে বোঝা যেত। একবার আমাদের স্কুলে একজন নতুন হেডস্যার মাথায় জিন্না টুপি পড়ে যোগদান করলেন। তিনি স্কুল ড্রেসের সাথে মাথায় টুপি পড়ার নতুন নিয়ম চালু করলেন। আমরা গোল লম্বা টুপি পড়তে শুরু করলাম। হক স্যার ঘোষণা দিলেন আমার ক্লাসে কেউ টুপি পরে বসতে পারবি না। টুপির আলোচনায় স্যার খেদের সাথে বললেন- ‘তোরা ব্যাকে (সবাই) টুপি হিনলে (পরলে) রামপদ (আমাদের ক্লাসমেট) কি হিনবো’? যতটুকু জানতাম এ নিয়ে হেড স্যারের সাথে তার নাকি ঝগড়া-ঝাটি হয়েছিল। যদিও কিছুদিন পর অসুস্থতার কারণে হেডস্যার চাকরি ছেড়ে দেন। আমরাও টুপি পড়ার দ্বৈত শাসন থেকে মুক্তি পাই।

সংক্ষপে এই ছিলেন আমাদের হক স্যার।
যাক যে কথায় ছিলাম। বিখ্যাত ব্যক্তিদের আত্মজীবনি-অবিভক্ত ভারত-পাকিস্থান-বাংলাদেশের রাজনীতির কথা । বইগুলির পাতা উল্টাতে উল্টাতে মনে হলো এসব পড়ার প্রয়োজন আর নেই।সবই আমি জানি।বইগুলি তুলে রাখলাম আর চোখের সামনে ভেসে উঠলো স্যারের সেই মুখ—তিনি চোখ বন্ধ করে সন তারিখসহ স্বচ্ছন্দে বলে যাচ্ছেন সব।তখন এ সবের গুরুত্ব কিছুই বুঝতাম না।শুধু ক্লাশে পড়া ফাঁকি দেয়ার জন্য বিভিন্ন উসিলায় এসব প্রসংগ তুলে দিতাম আর স্যার পড়া বন্ধ করে বলে যেতেন সব ইতিহাস।ক্লাসের ঘন্টা পড়ে যেতো পরের ঘন্টার স্যার এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন।এ জন্য তাঁকে হয়তো সমালোচানাও শুনতে হতো। আমাদের জন্যই স্যার এমন বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়তেন।স্যার আমাদের দুষ্টামি সবই বুঝতেন তার পরেও হয়তো ভাবতেন এসব সত্য ছাত্রদের জানা উচিত। আজ ভীষণ অনুশোচনা হচ্ছে—তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবো কিন্ত সে পথও বন্ধ কারন অনেক আগেই স্যার চির সত্যের দেশে চলে গেছেন।

স্কুলের স্যারদের কখনও বিখ্যাত হওয়ার কথা শুনিনি। তবে বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের মগজের কাঠামোটা তারাই গড়ে দেন।যার প্রকৃত সন্মান থেকেও তারা বিখ্যাত ভাবেই বঞ্চিত হন।হক স্যার বিখ্যাত হওয়ার কথা ভাবতেন না।তার নেশা ছিল সত্য শেখানো আর শত প্রতিকুলতার মাঝেও সাহসী সৈনিকের মতো তা প্রকাশ করা।জানিনা আমাদের হক স্যারের কোন ছাত্র বিখ্যাত হয়েছেন কিনা কিংবা ভবিষতে হবেন কিনা।তবে তিনি অন্তত: তার ছাত্রদের অসত্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে আংগুল উঁচিয়ে সাহসের সাথে ‘না’ বলতে শিখিয়ে গেছেন।
(সমাপ্ত)

No comments:

Post a Comment

Comments

Not using Html Comment Box  yet?

No one has commented yet. Be the first!

rss