প্রতিটা মানুষের কিছু বিশেষ বন্ধু থাকে , আমাদের আতিক ভাইয়ার অনেক গল্পে আমি রিমন ভাই এর অস্তিত্ব পেয়েছি রেজা ভাইএর যেমন মোল্লা ওরফে অপু ভাইয়া তেমনি আমার একজন ফ্রেন্ড কাজী । আমার জীবনের প্রথম বন্ধু কাজী , পুরো নাম কাজী জাহিদুল হাসান । ডাক নাম হেলাল । আমি কখনো এই নামে ডেকেছি বলে মনে করতে পারছি না ,আমার কাছে হেলাল শুধুই কাজী কখনো বা কাইজ্জা ,অবশ্য কাজীর চৌদ্দ গুষ্টির সবাই কাজী নামে পরিচিত। কাজীর বাবা কে যেমন আমার বাবা / আঙ্কেলরা কাজী সাহেব বলে সম্বোধন করতো তেমনি কাজীর বড় ভাইকেও আমরা কাজী ভাই বলে সম্বোধন করতাম , কাজীর একটা ছোট ভাই আছে. সেই পিচ্চিও কাজী নামেই পরিচিত !!!
আমি কাজী কে প্রথম দেখি স্কুল জীবনের একদম প্রথম দিন , এত বছর পর সেই স্মৃতি খুজে যত টুকু উদ্ধার করতে পেরেছি আমরা ফাস্ট বেঞ্চের কোন এক জায়গায় বসেছিলাম একটু পর পর কাজী আমার গাল টেনে দিচ্ছিল , কি কথা হইয়েছিল একদম মনে করতে পারছিনা । ক্লাস শেষ হবার পর আমার বড় ভাইয়া আমাকে স্কুল থেকে নিতে আসে , আমি ব্যাগ গুছিয়ে যাবার সময় কাজী কে আর খুজে পাইনি ।
ক্লাস থেকে বেড় হবার পর স্কুল গেটের কাছে এসে “ নইম্মা ” বলে একটা বিকট শব্দ করে উঠে । আমি তাকাতেই দেখি রবিনের মাস্ক ( কার্টুন –ব্যাটম্যান & রবিন) পরে আছে। আমারে একটা ধাক্কা দিয়ে দৌড় দিল ।
ভাইয়া একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলো , ছেলেটা কে ? মাস্ক কিনবি ?
আমার মাথায় তখন কাজীর মাস্ক পরে ধাক্কা খাওয়ার স্মৃতি আমাকে উথাল পাথাল করে দিচ্ছে । কাজির কাছে মাস্ক আছে আমার নেই আমি তখন সেই মাস্ক পাবার জন্য উসখুস করছি , আমি বললাম কাইজ্জা ( প্রথম বারের মতো কাজী কে কাইজ্জা বলে সম্বোধন করলাম , এখনো কাজি আমার কাছে শুধুই কাইজ্জা )
আমি বললাম হ্যা আমার ঐটাই চাই ।
ভাইয়া – ঠিক আছে বলে কিনে দিলো , তারপর জিজ্ঞাসা করল ও কি তোর বন্ধু ?
বন্ধু কি ভাইয়া ?
ভাইয়া তখন সম্ভবত একটা বিশাল লেকচার দিয়েছিল , একদম মনে করতে পারছিনা কি বলেছিল ।আমার মেমোরি খুব একটা পাওয়ার ফুল না প্রায় সব কিছুই ভুলে যাই, বন্ধু কি আমি তখনো জানিনা ,
ভাইয়ার কথা কিছুই বুঝলাম না ।
ভাইয়া তখন বলেছিল বড় হলে বুঝবি বন্ধু কি ?
কথাটা বুঝতে আমার কত সময় লেগেছিল এখন বলাটা মুশকিল কিন্তু এইটা জানি পরদিন থেকে স্কুলে গিয়েই আমি কাজী কে খুজতে থাকি । এইভাবে অনেকদিন চলতে থাকলো ...
ক্লাস সিক্স কি সেভেনে উঠার পর আমাদের অনেক কিছুই মধ্যে মিল দেখা দিতে শুরু করে । আমাদের চেহারায় কিছু মিল ছিল ,সাইজ প্রায় একই ছিল অনেক দিন ,যদিও কাইজ্জা একটা সময় পরে আর বড় হয় নাই grin emoticon আমরা ভিন্ন সেকশনে পরলেও কিছুক্ষন পর গিয়ে দেখা করে আসতাম আমাদের স্কুলের ইউনিফর্ম হোয়াইট শার্ট নেভি ব্লু প্যান্ট হলেও বৃষ্টি হলে যে কোন প্যান্ট পরা যেতো । আমরা দুই জন ক্রিম কালারের প্যান্ট পরে আসি ।আর শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি , একেবারে মুষল ধারে বৃষ্টি ,পুরো ক্লাসের প্রায় সবাই ভিজে একেবারে কাক হয়ে যাই । ক্রিম কালারের জর্জেট টাইপের কাপড়ের প্যান্ট পরে রোদ / বৃষ্টির মাঝে গেলে যে মান ইজ্জত বলে কিছু থাকে না ওইদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম । শার্ট ইন করা ছিল তাড়াতাড়ি খুলে যা একটু রক্ষা পেয়েছিলাম , তারপর থেকে আমরা দুই জনের কেউ আর ঐ প্যান্ট পরি নাই । তারপরের কিছু স্মৃতি আবার মনে পরছে না ।
আমরা স্টিল মিল কলোনির ছেলেরা ঐ বয়সে আমাদের কলোনি থেকে তেমন একটা বেড় হতাম না ।আসলে বেড় হতে দিতো না ,শুধু ঈদ এর সময় একটু ছাড় পেতাম, কিন্তু সবারই একি অবস্থা কেউ বাহিরের পৃথিবী সম্বন্ধে জানে না তাই সাহস করতাম না । ঈদে সম্ভবত কাজীর সাথেই প্রথম বেড় হই । ঈদ আসলে কাজী সকাল বেলায় কিভাবে যেন আমাকে খুজে বেড়াতে নিয়ে যেতো , কাজী আমি ,রায়হান আর রাসেল আর জাহাঙ্গির আমাদের কলোনির গেট থেকে বাহিরে যেতাম । মনে হতো বড় হয়ে গিয়েছি , আবার ভয় হতো বাসায় ফিরতে পারবো তো ? কাজী আর রাসেল ছিল বলে নিশ্চিন্ত থাকতাম । কাজী কে দেখে আমি অবাক হতাম কিভাবে এত সাহস করে এত দূর পর্যন্ত যেতে পারে? কোথায় স্টিল মিল কলোনি আর কোথায় হাটহাজারি ।
কাজী আর রাসেল যে এত মজা করতে পারে ঐ বয়সে আমি কল্পনাও করতে পারতাম না, কি যে ভাষা ব্যবহার করা শুরু করেছিল মনে হলে আমি এখনো আতকে উঠি ।কাজী আর রাসেল এর সাথে কোথাও গেলে শুরু হয় অসাধারন সব গল্প যা শুনলে শয়তান ও লজ্জা পাবে । এই গল্প আমি আমার ডায়েরিতেও লিখার সাহস পাইনা ।
ক্লাস সেভেনে আমাদের খুব প্রিয় একজন টিচার ছিল মালেক স্যার , স্যার এখন আর বেঁচে নেই । স্যার কে শ্রদ্ধাভরেই স্মরন করছি । মালেক স্যার এসেই বলতো কিরে কাজী আজ কয়টা বিয়ে পরাইলি ?
স্যার নমির টা সহ ৫ টা ।
ভাই আমাকে টানা টানি করার কি আছে ?
স্যার নমি আরো বিয়া করতে চায় ?
আমি একটু লজ্জাই পেতাম কাজীর আচরনে ।
ক্লাস এইট শুরু হয়ে যায় ।কাজীর মধ্যে একটা ভয়াবহ পরিবর্তন আসতে থাকে ,স্কুলের পরীক্ষায় কোন সাবজেক্টে মার্কস কম পেলে আমার কাছে এসে আমার ছোট খাটো পেশির মধ্যে ধারুম ধুরুম করে লাগাতো আর বলতো কম পাইলাম কেন ??? আর ক্লাসে আসতে যেতে তো গুতা গুতি আছেই । একটু পর পর আমার কাছে এসে বলে নমি দেখ কি সুন্দর একটা পরী যাচ্ছে রে । ইসসশ আহহহহ উফফফ ...... বুকে কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠে ।দেখ দেখ দেখনা ............ । এই ভাবে ক্লাস এইট শেষ হয় ক্লাস নাইন শুরু হয়। আমাদের ম্যাথ করাতো আনোয়ার স্যার। হাতে একটা বেত সারাক্ষন নাচানাচি করতো , পান থেকে চুন খসলেই সপাৎ সপাৎ করে পিঠের মধ্যে বেত টা বসিয়ে দিতো ।
স্যার একদিন উপপাদ্য বুঝিয়ে চেয়ারে বসে একটু ঝিমাচ্ছে । জাহাঙ্গির কানে কানে বলল আজ কে রাসেলের কি হইছে রে?
কি হবে আবার?
সারাক্ষন কেমন উদাস হয়ে আছে ? মন খারাপ নাকি ?
জানিনা । পারসোনাল জিনিষ আমি ঘাটাঘাটি করি না ।
কাজি পিছনের বেঞ্চ থেকে একটা চিরকুট দিলো । চিরকুটে ছিল
Rasel’s email a/c is not protected
আমার দম ফাটানো হাসি এসে পরেছিল । একটু পর পুরো ক্লাসে এই কথা ছড়িয়ে যায় । একটা বিশ্রী অবস্থার সৃষ্টি হয় , জাহাঙ্গির চিরকুট টাকে ম্যানুয়ালি ইমেইল করে দিলো । আর তাতেই স্যার বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে ।
সবাই কে জিজ্ঞেসা করে কি হয়েছে ? কেউ সাহস করে বলতে পারে নাই । আমাদের রবিন বলেই ফেলছিল স্যার ......
......তো কি হইছে ? এইটা নিয়ে এত হৈচৈ করার কি আছে ? তারপর যেই মাইর টা স্যার সেদিন দিয়েছিল এখনো মনে হলে পুরানো ব্যাথা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে ।মনে হয় এখনো পিঠে দাগ আছে । কাজী কে সেই কথা মনে করিয়ে দিলে এখনো বলে আমি গোসল করার সময় এখনো দেখি আমার পিঠের দাগ টা আমার দিকে তাকিয়ে আছে grin emoticon পরের দিন স্যার যথারীতি ক্লাসে এসে উপপাদ্য ৭ এর পড়া আদায় করছে । ২/৪ জনকে ইচ্ছে মতো মারলো । ভয়ে আমার অবস্থা শেষ। কাজী কে ডাকল , বোর্ডে উপপাদ্য একে প্রমান করতে বলল ।
কাজি শুরু করতেই আরেকজন স্যার এসে কিছু খাজুরে আলাপ করতে লাগলো আমাদের আনোয়ার স্যারের সাথে । কাজি সুযোগ বুঝে আমার আর জাহাঙ্গির এর সাথে দুনিয়ার আজাইরা আলাপ জুড়ে দিলো । আর এমন একটা ভান করে থাকল যেন উপপাদ্য প্রমান করছে ।
এক সময় স্যার এসে কত টুকু বলছে জাহাঙ্গির কে জিজ্ঞেস করলো ।
স্যার এর কাছে উপপাদ্য প্রমান করা আর বাঘের মুখে পরা একি কথা তার উপর গতকালের টগবগে স্মৃতি স্যার কে উত্তেজিত করে রেখেছে ।
আমি বললাম স্যার প্রমানিত পর্যন্ত। জাহাঙ্গির ও আমাকে সমর্থন করল ।
স্যার কাজীকে ছেড়ে আমাকে আর জাহাঙ্গির কে ধরলো ।ধরা তো না যেন রামডলা দেয়ার জন্য আমাদের দুই জন কে আটকেছেন।
abc ত্রিভুজ কে এমন ভাবে xyz এর উপর ফেললাম আর সাথে সাথে স্যার বুঝতে পেরেছে মুখস্ত ঝেড়ে দিচ্ছি। উপপাদ্যের সাইন সাধারণত a,b,c d দিয়ে হয় , এই গুলি পরিবর্তন করে ক , প , ৎ ,ক্ষ এই রকম সাইন দিয়ে প্রমান করতে বলল । ট্রাই করতে লাগলাম , ঐ তুই এক ত্রিভুজ এর উপর অন্য টা কত বার ফেলবি ? ঠাস ঠুস করে শব্দ হতে থাকল ।
আমার সাথে ইতরামি ।আমারে প্রমানিত শেখাও বলে আরেক দফা ঠাস ঠুস ...
আকাশে তো বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে না আমাদের উপর ঠাডা পরতেছে কেন রে নমি বলে ফিস ফিস করছে জাহাঙ্গীর। ক্লাস শেষ হবার পর আমি আর জাহাঙ্গির এক সাথে কাইজ্জা বলে চিৎকার করে উঠি ,
কাইজ্জা ও চিৎকার করে বলে তোরা মাইর খাইছস মামা এইটা প্রমানিত । grin emoticon
কাজির গল্পের শেষ নেই । ভদ্রলোক ক্লাসের সব চেয়ে সুন্দর মেয়েটার প্রেমে পরে । এই মেয়ে কে পছন্দ করেনা এই রকম বলদ হবার কোন কারন ছিল না। আমার ও ভালো লাগতো। শুধুই ভালো লাগা।
কাজী তো এক সময় প্রপোজ করেই বসে যথারীতি রিফিউজ হয় । শালা আমার কাছে এসে নরম পেশিতে ধারুম ধুরুম বসিয়ে দিতে থাকে । আর ... ভাই তোর জন্য আমি রিফিউজ হইলাম । তোরে আমি...
আর বলা যাচ্ছে না ।
একটু শান্ত হয়ে আমাকে সব কিছু বলে কি ঘটেছিল । আমি বললাম আমি কি করছি ।
... ভাই কি করছি মানে সবাই জানে তুই ওরে পছন্দ করিস ।
মামা আমি আবার কখন এই কথা বললাম ?
আমাদের পছন্দ গুলো কেন জানি এক বিন্দু তে এসে আটকে যায়। আমরা ক্রিকেট পছন্দ করতাম। স্কুল লাইফে কাজির ধারনা একি মেয়ে কে পছন্দ করতাম, আমরা একি সাবজেক্ট নিয়ে অনার্স/ মাস্টার্স করেছি ।
কাজী মজা করে বলতো দোস্ত আমাদের কত মিল চল আমরা একি ফ্যামেলি তে বিয়ে করবো , তোকে আমি ভায়রা বানাবো । আমি কাজী কে বলতাম তোর শ্বশুরের এক্টাই মেয়ে হবে ভায়রা হওয়া সম্ভব না ? কাজীর মাইর আবার শুরু হয় ।
মিলের মিছিলে আরেকটা মিল খুজে পাই , কাজী যে ওদের বংশের টাইটেল এইটা তো বুঝাই যাচ্ছে । আমি কাজীর মিল গুলির কথা বলছিলাম একটা আশ্চর্যের ব্যাপার আমার মা এর দিকের টাইটেল ও কাজী । তারমানে আমিও ৫০% কাজী।

কাজীও কম যায় না ,কাজী আমাকে কনফার্ম করে ওর ছেলের হলে নাম রাখবে ইফতি নমি তাহলে মিলের মিছিলটা আরো পারফেক্ট হবে । এইভাবেই দিন চলে যায় আমাদের । কত টা সময় চলে গেলো তবুও আমরা এখনো আগের মতোই আছি । এখনো কাজীকে দেখলেই স্কুলের সেই প্রথম দিনের ধাক্কা খাওয়ার কথা মনে পরে যায় । আমার অনেক ভালো বন্ধু আছে কিন্তু কাজী যে একটাই । অনেক আরোহী হিমালয়ে জয় করেছে কিন্তু হিলারি/ তেনজিং কে এখনো সবাই স্মরন করে কারন এরাই সর্ব প্রথম হিমালয়ে পদচিহ্ন রেখে পৃথিবীকে জানিয়ে দেয় মানুষের পক্ষে সব সম্ভব । কাজী তুই ও আমার সেই রকম প্রথম বন্ধু যার কাধে কাধ মিলিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যাওয়া যায় , সব কঠিন কাজ গুলো হাতের মুঠোয় আনতে না পারলেও স্বাভাবিক থাকা যায় । কাজী তুই অনেক ভালো থাকিস । সেই প্রথম স্কুলের দিনটির মতো করে অনেক অনেক ধাক্কা দিস অনেক মাইর দিস তবুও ভালো থাকিস।
No comments:
Post a Comment