Sunday, September 27, 2015

একদিন সকালে (এই গল্পের কাহিনী পুরোপুরি কাল্পনিক নয়)



(এই গল্পের কাহিনী পুরোপুরি কাল্পনিক নয় তাই ব্যাক্তি বিশেষে মিলে যেতেও পারে। মিলে গেলে সেটা কাকতাল ভাবার কোন কারন নেই। )
আযান শুনে হারুন সাহেবের ঘুম ভাংলো। ঘরের পাশেই মসজিদ, আযানটা বেশ জোরেই শোনা যায়। অন্যদিন আযানের আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায় হারুন সাহেবের। আজ দেরি হয়ে গেলো। তাড়াহুড়া করে ওজু করে তিনি মসজিদে যাবার জন্য তৈরি হলেন। ঘর থেকে বের হবার সময় দেখলেন তাঁর ছেলে পুলক উপুর হয়ে ঘুমিয়ে আছে। এভাবে শুয়ে থাকা স্বাস্থের জন্য খারাপ, অনেকবার বলা হয়েছে তাকে। বদভ্যাস ছাড়তে পারলো না ছেলেটা। তিনি নিঃশব্দে দরজা টেনে বেরিয়ে গেলেন মসজিদের উদ্দেশ্যে। তিনতলা থেকে নামার পথে সিঁড়ির ল্যান্ডিঙে দেখা আকতার সাহেবের সাথে। তিনিও মসজিদের উদ্দেশ্যেই রওনা হয়েছেন। দুজন একসাথে নামাজ পড়লেন। ইমাম সাহেবের নামও হারুন। হারুন হুজুর তাঁর সুললিত কণ্ঠে লম্বা মোনাজাত করলেন নামাজ শেষে। হারুন সাহেব ও আকতার সাহেব নামজ শেষে রোজই কিছুক্ষণ হাঁটেন। আজ হাঁটতে নেমে হারুন সাহেব দেখলেন কলোনিরই মুখচেনা কয়েকটি ছেলে রাস্তায় ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করছে। হারুন সাহেব বিশাল এই ফ্যাক্টরির নিরাপত্তা কর্মকর্তা। শুরুতে সবকিছুই তিনি সন্দেহের চোখে দেখেন। ছেলেগুলোর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরক্ষনেই ভুল বুঝতে পারলেন। ওরা প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়েছে। নিজের ছেলের কথা ভাবলেন তিনি। এই ভোরবেলায় মিলের সত্তর টনি ক্রেন দিয়ে টেনেও ছেলেটাকে বিছানা থেকে তোলা যাবেনা। ভালো অভ্যাসগুলোর কিছুই পেলনা ছেলেটা। একটা ছেলে এগিয়ে এসে সালাম দিল। হারুন সাহেব মৃদু হেসে সালাম নিলেন এরপর হাঁটতে থাকলেন রাস্তা ধরে।


অনেকক্ষণ ধরেই রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছে অসিমরা। ওরা পাঁচজন। সেই অন্ধকার থাকতে বেরিয়েছে আর এখন আলো ফুটে গেছে। গোল্ডলীফের প্যাকেটটা এর মধ্যেই খালি। ইউনুসের দোকান খুলবে সেই সাতটায়। সিগারেট আনতে হলে এখন যেতে হবে ডে নাইট হোটেলের কাছে অথচ এখন এই রাস্তা ছেড়ে কোথাও যাওয়া যাবেনা। এসব ভেবে অসিমের সিগারেটের তৃষ্ণা আরো বেড়ে গেল। সে অযথা অন্যদের সাথে রাগারাগি করতে লাগলো। উত্তেজনায় টগবগ করছে হিরু, রাসেল, মিজান আর ইমতিয়াজ। হাঁটতে হাঁটতে মসজিদের কাছে যেতেই ওরা দেখল নামাজ শেষ করে হারুন সাহেব আর আকতার সাহেব বের হয়েছেন। কোন কারন ছাড়াই সতর্ক হল অসিম, আজ কোন ঝামেলা চায়না সে। এর মধ্যে মিজান গাধাটা এগিয়ে গিয়ে হারুন সাহেব আর আকতার সাহেবকে সালাম দিলো। অসিমের ইচ্ছে করল মিজানের পিঠে দু চার ঘা লাগিয়ে দিতে। ভাগ্য ভালো উনারা দুজন কোন ভ্রুক্ষেপ না করে অল্প হেসে যেমন হাঁটছিলেন তেমনি হাঁটতে লাগলেন। অসিমরা উলটো ঘুরে পানির ট্যাঙ্কের দিকে হাঁটা শুরু করলো। ট্যাঙ্কের কাছাকাছি যেতেই একটা গাড়ির শব্দ পেল ওরা। পাঁচজনই একসাথে ঘুরে তাকালো। 

হ্যাঁ, আসছে গাড়িটা। একটা গাঢ় সবুজ রঙের টয়োটা কেমরি। গাড়িটা এখন স্কুলের গেটের সামনে।
রঞ্জু মিয়া মহাবিরক্ত। তাকে বলা হয়েছে ভোরের আলো ফোটার আগেই পার্টি গাড়ি চায়। সেই অনুযায়ী অন্ধকার থাকতেই সে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে পার্টির বাসার সামনে। আরে বাবা অন্ধকারে তো চোরাকারবারিরা কামকাজ করে। তোরা কি চোরাকারবারি? বেনসনের কার্টন সরাবি? এখন বাজে ছ'টা, পার্টির খবর নাই। বিরক্ত হয়ে রঞ্জু মিয়া লম্বা করে দুবার হর্ন বাজালো এরপর সিট ডাউন করে শুয়ে পরলো।
আজ রেবার বিয়ে। তার বাবা জোর করে তার বিয়ের বন্দোবস্ত করেছে। রেবা আপত্তি তুলেছিল। তার বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছে অসিমের নাম যেন তার সামনে উচ্চারন করা না হয়। সকাল থেকে কাঁদছে রেবা। তার মা আজীবন নিরীহ মহিলা। সারাজীবন স্বামীর কথা শুনেছে, আজও শুনছে। সূর্যের চেয়ে বালি গরমের মত রেবার বাবার চেয়ে রেবার ছোট ভাই সজলের তেজ বেশি। সে এসে জানিয়ে গিয়েছে নিচে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এখনই নামতে হবে সবার। তখনই রেবা দুবার গাড়ির হর্ন শুনলো। সে কাল রাতে সব জানিয়ে অসিমের কাছে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলো। এখন তার সন্দেহ হচ্ছে চিঠিটা অসিমের হাতে পৌঁছেনি। কিংবা চিঠি পেয়ে অসিম আর কিছু করার সাহস করে উঠতে পারেনি। রেবার মাথায় কিছুই আসছেনা কি করবে সে। 

সবাই নিচে নেমে গেছে। রেবার বাবা বসেছে সামনের আসনে। রেবার মা, সজল আর রেবা পেছনে। রেবার ভাই সজল একটু মোটাসোটা গড়নের। পেছনের সিটটা গাদাগাদি হয়ে গেছে একদম। গাড়ি চলতে শুরু করতেই রেবা সব আশা ছেড়ে দিলো, কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে। মেইন রোডে উঠার পর এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো রেবা, তার মনে ক্ষীণ আশা শেষ মুহূর্তে চলে আসবে অসিম। দেখল নুরসাফা সাহেব তাঁর দোকানের ঝাঁপ তুলছেন। আরেকটু সামনে যাঅর পর স্কুলের গেটের সামনে হারুন সাহেব আর আকতার সাহেবকে মর্নিং অক করতে দেখা গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেবা, সবকিছু স্বাভাবিক শুধু তাঁর জীবনটা অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। 

হঠাৎ করেই রেবা দেখলো দূরে পানির ট্যাঙ্কের কাছে চার পাঁচটা ছেলে গাড়ির শব্দে ঘুরে তাকিয়েছে। তাদের মধ্যে অসিমকে খুঁজে পেতে রেবার একটুও কষ্ট হলনা। এমনকি এতো দূর থেকেও সে অসিমের শার্টের ছেড়া পকেটটা দেখতে পেল। সেদিন দুষ্টুমি করতে গিয়ে সে অসিমের শার্টের পকেটটা ছিঁড়ে ফেলেছিল। মনে মনে রেবা ঠিক করল আজই সে ছেঁড়া অংশটা ঠিক করে দিবে।

হারুন সাহেব আর আকতার সাহেব সকালে হাঁটার উপকারিতা নিয়ে কথা বলছিলেন। নিজেদের ছেলেদের নিয়েও আফসোস করছিলেন। 

দেখেন এই ছেলেগুলো কত স্বাস্থ্য সচেতন। ভোর হতেই হাঁটতে বের হয়েছে আর পুলক দশটার আগে ঘুম থেকে উঠেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন হারুন সাহেব।

বিরক্তিতে মুখ বাঁকালেন আকতার সাহেব- আপনার পুলক আর আমার ডালিম কারো লাইফ স্টাইল ভালো না।
ঠিক এসময় সবুজ রঙের গাড়িটা তাঁদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। এর কিছুক্ষণ পরই তাঁরা একটা হট্টগোলের শব্দ পেলেন। দেখলেন চলে যাওয়া গাড়িটা ঘিরে স্বাস্থ্য সচেতন ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে আছে আর ভেতর থেকে কে যেন চিৎকার করছে "এই কুত্তার বাচ্চা সর"। 

দুজন দ্রুত গাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলেন। সকাল সকাল একি উপদ্রব শুরু হল রে বাবা।
জাভেদ ঘুমের মধ্যে একটা মেয়েকে স্বপ্ন দেখছিল। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছিল মেয়েটার সাথে। তাকিয়ে ছিল মেয়েটার বড় বড় চোখের দিকে। আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিলো মেয়েটার কাছে। হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে কাছে টেনে নিয়ে মেয়েটার চুলে নাক ডোবাল সে। হঠাৎ বিনামেঘে বজ্রপাত "এই কুত্তার বাচ্চা সর"। ধড়মড় করে উঠে বসলো সে। নাহ মেয়েটা বলেনি, বাইরে থেকে আসছে। জানালা দিয়ে উঁকি দিলো জাভেদ। জানালার সাথে লাগোয়া নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে দেখল একটা গাড়িকে ঘিরে কি যেন হচ্ছে। স্বপ্নটা দেখতে না পারার হতাশা নিয়ে "ধুশ শালা" বলে আবার শুয়ে পড়লো সে।

রেবার বাবা সামনে বিপদ দেখতে পেলেন। ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি থামাবা না, সোজা চলে যাও। রঞ্জু মিয়া পোড় খাওয়া ড্রাইভার। কখন পার্টির কথা শুনতে হয় আর কখন শুনতে হয়না তার ভালই জানা আছে। এখন পার্টির কথা শুনলে পিঠের চামড়াটা পাপোষ বানিয়ে রেখে যেতে হবে স্পষ্টই বুঝতে পারছে রঞ্জু মিয়া। সে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর সামনে গিয়ে গাড়ি থামালো। মিজান দৌড়ে এসে গাড়ির পেছনের দরজা ধরে টানাটানি করতে লাগলো। ঠিক তখনই রেবার বাবা বাজখাই গলায় হুঙ্কার দিলেন "এই কুত্তার বাচ্চা সর"। মিজান ঘাবড়ে গিয়ে সরে দাঁড়ালো। 
রেবার বাবা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে তুর্কী নাচ নাচতে লাগলেন। এটা কি মগের মুল্লুক? তোরা সব সন্ত্রাসী। দিনে দুপুরে কিডন্যাপ। সব গুলারে আমি জেলে ঢুকাব। 

এমন সময় দৃশ্যপটে হাজির হলেন হারুন সাহেব আর আকতার সাহেব। তাঁরা এখনো ঘটনা বুঝে উঠতে পারেননি। ঠিক সেই মুহূর্তে রেবা গাড়ি থেকে বের হয়ে ধীর উচ্চারনে স্পস্টভাবে বলল আমি অসিমের সাথে যেতে চাই। সাথে সাথে হট্টগোল থেমে গেলো। মুহূর্ত মাত্র। এরপরই রেবার বাবা দ্বিগুণ তাণ্ডবে ধমকা ধমকির তুবড়ি ছোটালেন তবে এবার একা নয় সাথে তাঁর ছেলে সজলও যোগ দিয়েছে। রেবার বাবা ঘোষণা দিলেন তাঁর মেয়ে তিনি কেটে পানিতে ভাসিয়ে দেবেন তবু অসিমের মত লাফাঙ্গার হাতে দেবেন না। অসিম এতক্ষণ চুপ ছিল এবার নির্বিকার ভাবে উত্তর দিলো "আমি পানি থেকে কাটা অংশগুলো খুঁজে এনে ফ্রিজে রেখে দিব তবু অন্য কারো কাছে রেবাকে বিয়ে দিতে দিবনা"। হারুন সাহেব আর আকতার সাহেব রেবার বাবাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। 
আসেন ভাই আমরা একসাথে বসে একটা ফয়সালাতে আসার চেষ্টা করি। আকতার সাহেব রেবার বাবাকে বললেন।
কিসের ফয়সালা? আমি এখান থেকে মেয়েকে নিয়ে নিরাপদে চলে যেতে চাই এটাই ফয়সালা। একগুঁয়ে ভাবে উত্তর দিলেন রেবার বাবা। 
এসময় রেবা এগিয়ে এসে জানালো সে কোথাও যেতে চায় না।
রেবার বাবা আর মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন না, সজোরে চড় লাগালেন মেয়ের গালে।
এসময় ঘটনাস্থলে ফ্যাক্টরি জিএম আলি সাহেবকে দেখা গেলো। তিনি সব শুনলেন। এরপর সবাইকে তাঁর বাসায় যেতে বললেন। রেবার বাবা ততক্ষণে ভেঙ্গে পড়েছেন। তিনি জানালেন তিনি আলি সাহেবের বাসায় যাবেন না।
মেয়েকে চিরতরে ফেলে রেখে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে নিজের বাসার দিকে হাঁটতে থাকলেন মাথা নিচু করে। 
সবাই আলি সাহেবের বাসায় গিয়ে বসলো। আলি সাহেব অবস্থার গুরুত্ব বুঝে তখনই কাজি ডেকে আনতে লোক পাঠালেন। অসিম চোরা চোখে বারবার তাকাচ্ছে রেবার দিকে। তার ভাবতেই কেমন অদ্ভুত লাগছে যে এই মেয়েটা আর কখনই তাকে ছেড়ে যাবেনা। রেবা ফুঁপিয়ে কেঁদে যাছে অনবরত। আলি সাহেবের ছোট মেয়ে ঘুম ঘুম চোখে বারবার উঁকি দিয়ে যাচ্ছে, কৌতূহলে উত্তেজনায় টগবগ করছে মেয়েটা।

আধা ঘণ্টার মধ্যেই অসিম-রেবার বিয়ে হয়ে গেলো। ইমতিয়াজ কোন ফাঁকে গিয়ে যেন আধা কেজি খুরমা কিনে এনেছে। সে মহা উৎসাহে খুরমা বিতরন করতে লাগলো। হারুন সাহেব বিরক্ত চোখে ছেলেগুলোর দিকে তাকালেন। কোথায় তিনি ভেবেছিলেন ওরা প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছে। নিজের ছেলের কথা ভেবে এবার তিনি কিছুটা তৃপ্তি বোধ করলেন।

রেবার কান্না বন্ধ হয়েছে। রেবাকে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসার পরই রেবা বলেছে এক্ষুনি সুঁই সুতা দাও। অসিম অবাক হয়ে রসিকতা করেছে সুঁই সুতা দিয়ে কি হবে? মালা গাঁথবে নাকি? 
তিন দিন ধরে পকেট ছেঁড়া শার্ট পরে ঘুরছো। তোমার খারাপ লাগেনা?
রেবা একমনে পকেট মেরামত করছে আর অসিম তাকিয়ে আছে রেবার দিকে। 
আহ! এভাবে যদি সারাজীবন তাকিয়ে থাকা যেত।

No comments:

Post a Comment

Comments

Not using Html Comment Box  yet?

No one has commented yet. Be the first!

rss