Wednesday, September 23, 2015

পারুল আমার বুবুর নাম



কবিতা হলো। এবার গল্প হোক।
পারুল আমার বুবুর নাম
----------------------------
গুলিস্থানে বাসের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। বিশাল লাইন। বাসের নাম সময় নিয়ন্ত্রন। হকাররা ঘুরেঘুরে বুট বাদাম বিক্রি করছে। একটা বাচ্চা মেয়ে দেখলাম বাদামের পোটলা হাতে ঘুরছে। বাদাম বেচার প্রচেষ্টা। অপেক্ষার জন্য বাদাম কার্যকর জিনিস। মেয়েটাকে ডাকলাম। মানিব্যাগ খুলে পাঁচ টাকার নোট খুঁজে পেলাম না। এক পোটলা বাদাম পাঁচ টাকা। পঞ্চাশ টাকার ভাংতি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলো মেয়েটা। ওকে জিজ্ঞেস করলাম কি নাম রে তোর?
পারুল। অস্থির হয়ে জবাব দিলো মেয়েটা। ভাংতি থাকলে দেন নাইলে বাদাম ফেরত দেন।

প্যান্টের পকেটে দশ টাকা পাওয়া গেলো। কি ভেবে আমি দুই ঠোঙ্গা বাদাম কিনে ফেললাম।
পারুল। পারুল বু। গুলিস্থানের ব্যস্ত রাজপথে দাঁড়িয়ে আমার কাঁকনপুরের পারুল বুর কথা মনে পড়ে গেলো। আমাদের এক বাড়ি পরেই পারুল বু দের বাড়ি। পারুল বু তখন কলেজে পড়ে। লম্বা সুন্দর একটা মেয়ে। মাথা ভরা চুল। পারুল বু সবসময় বলত আমি নাকি পারুল বুর পিছে পিছে ঘুরি।


ওই ছেমড়া তুই আমার পিছে পিছে ঘুরছ কেন রে? তোর লেখাপড়া নাই?
কে কইছে আমি তোমার পিছে ঘুরি? আমিতো চাচির কাছে আইছি।
তো যা আম্মার কাছে। আমার পিছে কি?
ছোটন রে ও ছোটন, কইরে তুই?
মা ডাকছে। নিশ্চয় বাজারে পাঠাবে। আমি জবাব দিলাম না।
আবার ডাকছে। 
ছোটন কইরে তুই বাপ?
আর জবাব না দিয়ে পারা গেলনা।
কি মা? আইতেছি...।
আমি দৌড়ে মাজু কাকাদের উঠান পেরিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়ালাম।

একটু বাজারে যা তো বাপ। আমার সেলাইয়ের সুতা শেষ হইয়া গেছে। দুইডা সুতার রিল কিন্না আইনা দে।
মা আমার হাতে টাকা আর দুটো কাপড়ের টুকরো দিয়ে দিলো। কাপড় দুটোর রঙ মিলিয়ে সুতা আনতে হবে। সুতা কেনা অনেক যন্ত্রনা। কখনোই পুরোপুরি রঙ মিলানো যায়না। রঙ মিললেও মার নানান বায়নাক্কা। বেশি কড়া হয়েছে কিংবা আরেকটু গাঢ় হলে ভাল হতো।
বাজার আমাদের বাড়ি থেকে আধা মাইল দূরে। এবাড়ি ওবাড়ির ভিতর দিয়ে গেলে দূরত্ব কিছু কম হয়। বড়রা বাড়ির ভেতর দিয়ে যেতে পারেনা। ছোটদের যেতে বাঁধা নেই। আমাদের বাড়ি পেরিয়ে প্রথমেই মাজু কাকাদের বাড়ি। মাজু কাকা প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার ছিল। এখন রিটায়ারমেন্টে। সারাদিন সামনের ঘরে বসে থাকে ভূঁইয়া বাড়ির নবু ভাইজানের সাথে। নবু ভাইজান মাজু কাকার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট কিন্তু দুজনের খুব ভাব। দুজনে বসে কত কথা বলে। কিছু কথা বুঝি কিছু বুঝিনা।

বুঝলি নবু, সাগরে পাইপ ঢুকায়া গ্যাস তুলতাছে। আমরা যেমনে পাইপ দিয়া পানি তুলি তেমনে। বিজ্ঞান অনেক আগাইছে।

পাইপ দিয়া গ্যাস ? তাইলে তো কাকা অনেক পাইপ লাগবো মনে হয়। পূব পাড়ায় টিপকল বসাইতে গিয়া পানি পায়না। শেষে এগারোডা পাইপ গাড়ছে পরে পানি পাইছে। গ্যাস তুলতে তো মনে হয় পঞ্চাশটা পাইপ লাগবো। কি কন কাকা?

আরে বেক্কলে কয় কি। এইডা কি তোর টিনের বালতির তলা? বেশুমার পাইপ লাগে সাগর থেইকা গ্যাস তুলতে।
উঠানে আমাকে দেখেই মাজু কাকা ডাক দিলো- কই যাস রে ছোটন?
বাজারে যাই কাকা। মার লাইগা সুতা আনতে।

তোর মা কি এতো সিলাই করে তোরে দুইদিন পর পর সুতা আনতে বাজারে পাডায়? শোন এদিক আয় আমার লাইগা এক প্যাকেট কেঁচি সিগারেট আনবি। এই নে টেকা। নবু ভাইজান মাজু কাকার উপর চটে উঠে।
কাকা আপনে সিগারেটটা ছাড়েন তো। ডাক্তারে না আপনেরে মানা করছে সিগারেট খাইতে।
মাজু কাকা নবু ভাইজানের দিকে তাকিয়ে হাসে।
আমি পারুল বু দের উঠানে গিয়ে উঠি। ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি বুবু গুনগুন করে গান গাইছে। বুবুর গানের গলা সুন্দর। পারুল বু আমাকে দেখেই তাড়া করে।আবার আইছসরে ছেমড়া।
আমি হাসতে হাসতে পালিয়ে যাই। এটা পারুল বুবুর সাথে আমার খেলা।

বাস এসে গেছে। সময় নিয়ন্ত্রন। সময়কে নিয়ন্ত্রন করা গেলে চমৎকার হতো। আমি নিশ্চয় পারুল বু কে নিয়ে আবার ওই সময়ে যেতাম। পারুল বু গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পর আর আমার সাথে দেখা হয়নি। বুবুর উপর আমার অনেক অভিমান জমে আছে। আমি জানি পারুল বু ঢাকাতেই আছে। আমি কখনো বুবুকে খুঁজে বের করবোনা। সেই আমাকে খুঁজুক। বাস ছাড়ল। আমার পাশের ভদ্রলোক এরই মধ্যে ঘুম। আমি দুই হাতে দুই ঠোঙ্গা বাদাম নিয়ে বসে আছি।
মিন্টু ভাইকে আমার ভাল লাগেনা। আমাকে দেখলেই শুধু মাথায় ঠুয়া দেয়। পারুল বু কে একদিন বলেছিলাম-
বুবু মিন্টু ভাই আমারে খালি মারে। তুমি কিছু কইতে পারোনা। তোমার লগে তো অনেক খাতির। তুমি মানা করলে আর মারব না।

আমার কথা শুনে বুবুর সে কি হাসি। আমার লগে খাতির তোরে কেডা কইছে রে? অনেক পাকনা হইছস।
মিন্টু ভাইয়ের শ্যালো ইঞ্জিনের তৈরি একটা ড্রেজার নৌকা আছে। ওটা দিয়ে নদী থেকে মাটি তুলে মানুষের জায়গা ভরাট করে দেয়। ব্যাপারটা মনে হয় অবৈধ কিছু। একদিন পুলিশ এসে মিন্টু ভাইকে তার ড্রেজার নৌকাসহ নিয়ে গেলো। তিনদিন পর হাসতে হাসতে ফিরে এসে সবাইকে মিষ্টি খাওয়াল মিন্টু ভাই। এর কিছুদিন পর দেখলাম মিন্টু ভাইয়ের আগের ছোট নৌকার বদলে আরও বড় লোহার নৌকা নদী থেকে মাটি তুলছে। আমরা সবাই আবার মিষ্টি খেলাম। যে তিনদিন মিন্টু ভাই জেলে ছিল সে কয়দিন পারুল বু মন খারাপ করে বসে ছিল। আমি কথা বলতে গেলে বলত ছোটন তুই যা তো, ভ্যারভ্যারাইছ না। আমি চাচির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ফিরে যেতাম।

ক্লাস সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছি বলে পুরস্কার হিসেবে একটা বই পেয়েছি স্কুল থেকে। বইয়ের নাম ছোটদের জ্ঞানের কথা। সেই তখন থেকে বইটা হাতে নিয়ে বসে আছি পারুল বু কে দেখাব বলে। বুবু আসছেই না। প্রতিদিন এসময়ে মায়ের কাছে আসে গল্প করতে আজ আসছে না। মাও কোথায় যেন গিয়েছে। শেষে বইটা নিয়ে আমিই গেলাম বুবুর কাছে। গিয়ে শুনি মাজু কাকার খুব অসুখ তাই সবাই ওই বাড়িতে।
বাস কন্ডাক্টর শাহবাগ শাহবাগ বলে হাঁক দিচ্ছে। শাহবাগ এসে গেছি। পাশের ভদ্রলোকের ঘুম ভেঙ্গেছে। হন্তদন্ত হয়ে বাস থেকে নামলো। রাস্তা পার হয়ে বারডেমের দিকে যাচ্ছে। এই বারডেমেই মারা গিয়েছিল মাজু কাকা। চাচি মাজু কাকার নিঃসাড় পলকা শরীরটা নিয়ে ফিরে গিয়েছিল গ্রামে। বাস আবার চলতে শুরু করেছে শেরাটন থেকে বাংলামটর। আমার দুই হাতে পারুলের দেয়া বাদামের ঠোঙ্গা।

মাজু কাকার উঠানে রাজ্যের মানুষ। নিঃসন্তান এই দম্পতিকে এপাড়া ওপাড়ার সবাই পছন্দ করে। জোহরের পর জানাজা হবে। পুরুষরা সবাই দাফনের ব্যবস্থা নিয়ে ব্যস্ত। মা চাচিরা মাজু চাচিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আসলে সান্ত্বনা দেয়ার মতো কিছু ছিলনা। কেঊ কাঁদলে তাকে সান্ত্বনা দেয়া যায়। মাজু চাচি কাঁদেনি। পাথর হয়ে বসে ছিল। আমি সেই তখন থেকে পারুল বুর সাথে সেঁটে আছি। মিন্টু ভাই দুবার এসে ঘুরে গেছে। জানাজা শুরুর আগে মসজিদের ইমাম হুজুর বললেন-
মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে ভাল কিছু বলা রাসুলে করিমের সুন্নত। আপনারা কেঊ মাজু মিয়া সম্পর্কে কিছু বলবেন?
সবাই ঠেলেঠুলে নবু ভাইজানকে এগিয়ে দিলো। তুমিই কও নবু। তোমার লগেইতো থাকত সারাদিন। নবু ভাইজান কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো মাজু কাকার নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে। তারপর কেঁপে কেঁপে উঠে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। মাজু কাকা সম্পর্কে দুটা ভাল কথা আর বলা হলনা কারো। এরপর যখনি মাজু কাকার উঠান পার হই দেখি নবু ভাইজান একাএকা দাওয়ায় বসে আছে। চাচি এসে মাঝে মাঝে বলে নবু যাও বাড়িত যাও। নবু ভাইজান নিঃশব্দে উঠে চলে যায়।

খামারবাড়ি পার হয়ে গাড়ি বিজয় স্মরনির পথে। দুই পাশে শত শত মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এদের মধ্যেই কেঊ একজন হয়তো আমার পারুল বু। আমার মনে থাকেনা যে পারুল বুর বয়স বেড়েছে। চলে যাওয়ার আগে যে পারুল বু পিছু ফিরে তাকিয়েছিল আমার কাছে পারুল বু এখনো তেমনি।

পারুল বুর যেন কি হয়েছে। কারো সাথে কথা বলেনা। আমি কাছে গেলে দূর দূর করে। আমি শুধু মিন্টু ভাইকে খুঁজি। কোথায় যে গেলো মানুষটা। মিন্টু ভাই ফিরে এলেই বুবু আমার সাথে আগের মতো হেসে হেসে কথা বলবে। পারুল বু মাঝে মাঝে আমাকে এসে জিজ্ঞেস করে তোর মিন্টু ভাইরে পাইলি ছোটন? কি মলিন বুবুর মুখটা। চোখের নিচে কালো দাগ। ইচ্ছে হয় মিথ্যে করে বলি হ বুবু, কান্দির পাড়ে বইয়া আছে দেখলাম। আমি নিঃশব্দে মাথা নাড়ি যেন মিন্টু ভাইকে খুঁজে না পাওয়াটা আমারই দোষ। মা, ফারুক ভাইয়ের মা, অন্য বাড়ীর চাচিরা কি নিয়ে যেন ফিসফিস করে। আমাকে দেখলেই চুপ হয়ে যায়। কাছে গেলে মুখ ঝামটা দেয়- ওই ছেমড়া বড়রা কথা কইতে লইলে মাঝখানে আইয়স কেরে? যা এন্তে। আমি চলে যাই। মাঠে গিয়ে খেলি বা লাল গরুটার গা চুলকে দেই।

গাড়ি রোকেয়া স্মরনি দিয়ে উল্কার বেগে যাচ্ছে। সময়টাও যে কখন উল্কার মতো চলে গেলো বুঝতেই পারলাম না। এতগুলো দিন তো আমার পারুল বুর কথা মনে পড়েনি আজ কোত্থেকে এক বাদাম বিক্রেতা মেয়ে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। ছোট্ট পারুলের দেয়া দশ টাকার বাদাম আমার অস্তিত্ব ধরে নাড়া দিলো যেন।

পারুল বুর শরীর দিন দিন আরো খারাপ হতে লাগলো। বুবুর মাও আর আমাদের বাসায় আসেনা। মিন্টু ভাইয়ের খোঁজ আজো পাওয়া গেলনা অথচ মিন্টু ভাইয়ের লোহার নৌকা আগের মতই নদী থেকে মাটি তুলে যাচ্ছে। আমি প্রতিদিনই কান্দির পাড়ে মিন্টু ভাইয়ের আড্ডায় গিয়ে খোঁজ নেই মিন্টু ভাই এসেছে কিনা। মিন্টু ভাইয়ের বন্ধুরা আমাকে দেখলেই কিভাবে যেন হাসে। আমি ফিরে আসি বাড়িতে। মার কাছে শুনলাম পারুলবুরা গ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে যাবে। সত্যি কিনা জানার জন্য ভয়ে ভয়ে পারুল বুর কাছে গেলাম। বুবু আজ আমাকে দেখে বকলো না। আদর করে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
বুবু তোমরা নাকি ঢাকা চইলা যাইতেছো?
হ রে ভাই।
মিন্টু ভাই আইলেও যাইবা?
বুবু একটু হাসল। কিছুই বলল না।
এক সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে দেখি পারুল বু দের উঠানে বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে রাখা। বাড়ীর ঘাঁটে একটা নৌকা বাঁধা। বুবুর মা আমার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সেদিন আমি আর স্কুলে গেলাম না। নৌকায় উঠতে গিয়ে পিছনে ফিরে বুবু আমাকে দেখে ডাকল। কাছে যেতেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।

ছোটন রে, ভাই আমার লেখাপড়া ঠিকমতো করিস। আর মাজু চাচিরে একটু দেখিস।
নৌকা নদীতে পড়ার পর আমিও নৌকার সাথে সাথে পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম। কালা মিয়ার খালে ঢুকে নৌকাটা হারিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত পারুল বু আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। কি করুণ সেই দৃষ্টি।
সাড়ে এগারো বাসস্ট্যান্ড। কন্ডাক্টর চেঁচাচ্ছে। এখানেই নামতে হবে আমার। নেমে ফিরে তাকালাম। চলে যাচ্ছে গাড়িটা। সাথে পারুলের দেয়া দুই ঠোঙ্গা বাদাম।
(০৪/০৭/২০১৩)

No comments:

Post a Comment

Comments

Not using Html Comment Box  yet?

No one has commented yet. Be the first!

rss