Monday, September 7, 2015

হার না মানা মানুষের গল্প


বার্ষিক পরিক্ষার রেজাল্টের পর যখন নতুন ক্লাসে ঢুকলাম। দেখি আমাদের চিরাচরিত পিছনের সারির বেঞ্চে(গুনধরদের স্থায়ী আসন)নতুন মুখের পুরাতন বাসিন্দা। আমাদের নতুন ক্লাসের নাম ৭ম শ্রেণী। পূর্বের বছরের অভিজ্ঞতা সস্পূর্ন যে বন্ধুকে আমরা পেলাম, তার এক মাথা কাচা পাকা চুলের জজ্ঞাল। গায়েগতরে আমাদের চেয়ে বেশ ভোলা-ভালি। চেহারায় রাজ্যের লজ্জা- শরম নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। কয়েক দিনের মধ্যে আমাদের ভীষণ রকম বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হলো পিছনের বেঞ্চের গুনধর ছাত্ররা বিদ্যা অর্জন ছাড়া যেমন বিচিত্র সব গুনের(!!) অধিকারী হয়। তার তেমন কোন গুনই ছিল না। তবে হা, তার একটা বিশেষ গুন ছিল। তা হলো, সে মহা-ধর্য্য সহকারে নির্বিকার স্যারদের প্যাদানি খেতে পারতো। একদিন এক স্যার তাকে আচ্ছা মত মেরে-টেরে বিরক্ত গলায় বললো----“আস্তো একটা পাঠা । তোকে মারাটা পন্ডশ্রম ছাড়া কিছু-ই না”। আমরা তার সমব্যাথি। তাকে বলি স্যাররা মারতে এলে একটু লাফা-লাফি আও-কাউ করলেই তো স্যাররা থেমে যায়। জবাবে সে তার মার খাওয়া জাগায় মালিশ ছাড়া কিছুই বলতো না।


আমাদের মধ্যে সে সাবার আগে ক্লাস নাইনে দাড়ি শেভ করে ফেললো। আমাদের সেকি কৌতুহল! তার গালে হাত দিয়ে দেখি। সেভ সম্পর্কে এটা সেটা জিজ্ঞেস করি। সেলুনে নাকি নিজেই সেভ করলি। কি ব্লেড দিয়ে করলি ইত্যাদি। সে মিটমিট করে হাসে আর সিয়ানা ভাব নিয়ে জবাব দেয়।

এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম সে আমাদের বন্ধু রামপদ পুরো নাম রামপদ জলদাস। সারা জীবনে তাকে দু’বার রাগতে দেখেছি। একবার স্যারের কি একটা প্রশ্ননের জবাব দিয়ে সে বসতে যাবে, আমার কি মনে হতে একটা বই মুড়িয়ে তড়িৎ তার বসার জায়গায় খাড়া করে ধরে রাখলাম। যেই সে বসতে গেছে ওমনি অপ্রত্যশিত উচু আসনের ধাক্কায়---“ও বাজিরে” বলে দ্বাড়িয়ে গেল। আর দূর্বল বেঞ্চও সাথে সাথে ক্যাচ্-র ক্যাচ করে উঠলো। এক মুহুর্তকাল সে আমার দিকে ক্রদ্ধচোখে চেয়ে থেকে বিশাল এক—এ......ই বলে হুংকার দিল। তারপর তার সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে এক ঘুষি দিয়ে কাত করে ফেল দিলো। স্যারের ভয়ে আমরা দু’জন দ্রুত স্বাভাবিক। স্যার এলেন আমাদের দাঁড় করালেন। কোন কিছু বলা-কওয়া ছাড়া আচ্ছা মত দু’জনকে ধূনে চলে গেলেন। আমরা দু’জন তখন আবার বেহায়ার মত নি:শব্দে হি হি করছি।

এতো গেল এক দিনের কথা। দ্বিতীয় ঘটনা হলো----স্কুলের মাঠে সন্ধার আগে আগে আড্ডাবাজী করে ফিরে যাবো। এ সময় আমাদের আরেক ইবলিশ সদস্য গোলাম ফারুক(আমেরিকা প্রবাসী) বিদ্যুৎ গতিতে রামপদের লুংগি একটানে নামিয়ে দিয়ে দৌড়। আমরা সবাই হাসছি। রামপদ বঙ্গবন্ধুর মত এক আংগুল উচু করে রাগে বিশুদ্ধ চাটগাইয়া ভাষায় ঘোষণা দিল---‘যে শালায় আমার লুংগি খুইল্লে(খুলছে) সে শালায় ফরাই(পরিয়ে) না দিলে আই(আমি) লুংগি ফইত্যান্ ন(পরবোনা)—ফইত্যান্ ন-ফইত্যান্ ন”। বলে কঠিন ভাবে উন্মক্ত নিম্নাঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।(ইতোপূর্বে মসজিদে আমিও একই কাজ করে ছিলাম । সেখানে আমার লংগির নিচে হাফ প্যান্ট ছিল কিন্ত রামপদের লুংগির নিচে কিছুই নেই)আমরা তাকে ঘিরে ধরে লুংগি তুলে দেই কিন্তু না, ঐ শালা ফারুইক্কা-ই পিন্দান ফরিবো(পড়াতে হবে)। সবাই মিলে তাকে শান্ত করি। এরপর থেকে আমরা লুংগি টানাটানির চর্চা ছেড়ে দেই। সে হিসাবে রামপদ ছিল আমাদের শেষ লুংগি ভিকটিম।

এবার আমাদের বন্ধু রামপদের না বলা কষ্টকর জীবনের কথা বলি। 
ও সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতো। কেমন যেন অপরাধি অপরাধি পলায়ন পর ভাব। কোন বিষয়ে তার কোন মন্তব্য নেই। তার পক্ষে বিপক্ষে যাই ঘটুক সে যেন ধরেই নিয়েছে এ সব হবেই। এবং এগুলো মেনে নেয়া ছাড়া তার কোন উপায় নেই।তাই চুপচাপ সয়ে যাওয়াই ভাল।

নতুন গেইম টিচার হমিদ স্যার আমাদের ক্লাসে এলেন। সবার নাম, বাবা কি করেন? বলার জন্য নির্দেশ দিলেন।আমরা এক এক করে বলে যাচ্ছি। রামপদের সিরিয়াল এলে সে দাঁড়িয়ে নাম বলার পর মলিন মুখে ছোট্ট করে বললো আমার বাবা লেবার। আমার বিশ্বাস সেদিন সে ঐরকম করার কারণ —এক সে তার বাবা সস্পর্কে মিথ্যা বলেছিল আর রামপদ ছিল নিচুজাতের হিন্দু মানুষ।সে জন্যই হয়তো সে বিব্রত ছিল। তার পিতা ছিলেন আমাদের কলোনীর পরিচ্ছন্ন কর্মি এক কথায় যাকে বলে সুইপার।যেটা আমরা জানতাম না এবং আমরা কোন দিন প্রয়োজনও মনে করিনি কার বাবা কি করেন। আজও রামপদের সেদিনের মুখটা মনে হলে ভীষণ খারাপ লাগে।
আমরা সবাই যখন দুপুরে টিফিন করার জন্য বাসায় যেতাম। রামপদ বাসায় যেতো না। কোন দিন এসে দেখতাম সে বেঞ্চে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। নয়তো শুকনো মুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।সাহস হতো না তাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করার। কে জানে দরিদ্র পিতার সংসারে হয়তো তার সারদিনই কেটে যেতো অভুক্ত থেকে। এ জন্য রামপদের মুখে প্রায়ই রোজাদারদের মত গন্ধ হতো।

তার সব কিছুই ছিল পুরাতন। বইখাতা কলম পোষাক পরিচ্ছদ সব। নতুন বছরে আমাদের স্কুল ড্রেস থেকে সব বদলে নতুন হতো। রামপদের সবই পুরাতন থাকতো। আগের ক্লাসের ছাত্রদের থেকে বই মেনেজ করতো। এক স্কুল ড্রেস ছাড়া তার দ্বিতীয় কোন প্যান্ট সার্ট ছিল কিনা তা আমি দেখিনি।সেই স্কুল ড্রেসের প্যান্টা যে কবে বানিয়ে ছিল সে ছাড়া কেউ বলতে পারতো না। কারণ কতবার যে সে প্যান্ট অল্টার করে এ্যাডজাষ্ট করা হয়েছে তা কোমরের পিছনে আর দু’সাইডের সেলাই দেখলেই বলে দেয়া যেতো। পায়ে এক জোড়া চপ্পলে কতবার যে মুচি সেলাই করেছে তা হয়তো সেও জানতো না।

আমাদের দূচিন্তা ছিল পড়াশোনা নিয়ে আর রামপদের দূ:চিন্তা ছিল---এক রুমের বাসায় অনেক ভাই বোনের মাঝে শোয়ার জায়গা নিয়ে।একবেলা ক্ষুধায় খাবার নিয়ে,তার জাত –পাত নিয়ে, সমাজে কে কি ভাবলো তা নিয়ে। এতো কিছুর পর স্বাবিকভাবে একটা ছেলের লেখা পড়া ছেড়ে দেয়ার কথা কিন্তু রামপদ তা করেনি। অথচ পড়াশোনাও সে ভাল করতে পারতো না। টেষ্ট পরীক্ষায় সে এ্যালাউ হতে পারলো না। আমি,বাপ্পি আর মোজাম্মেল ছিলাম তার সবচেয়ে বেশী কাছের। আমাদের কাছে শুধু বললো আর আমার মেট্রিক পাশ হলো না। ওর কথায় আমাদের মন খরাপ হয়ে গেলো। পরামর্শ করলাম স্যারদের রিকোয়েস্ট করবো। ভাল কাজের জন্য ভাল ছাত্র দরকার। কিন্ত আমাদের ভাল ছাত্রটি আবার আমাদের সকল দুস্কর্মের সহযোগী(যা সাধারনত ভাল ছাত্রদের বেলায় কখনই দেখা যায় না) সে আমাদের মোজাম্মেল(ডা: মোজাম্মেল)। তাকে বলতেই সে এক কথায় রাজী এবং ক্লাসের সবাই হেড স্যারের(আহাম্মেদ কবির) কাছে গেলাম। স্যার কোন প্রকারেই রামপদকে এ্যালউ করতে রাজি হলেন না। তবে তিনি বুদ্ধি দিলেন--- আমাদের নাইট স্কুল থেকে পরিক্ষা দিতে। এ জন্য তিনি রামপদকে টেষ্টে পাশের টি-সি দিতে রাজি হলেন। আমরা এতেই খুশি। সবাই রামপদের পরীক্ষার জন্য সব রকম সহযোগীতা করতে থাকলাম। কোন কোন স্যার মন্তব্য করলেন রামপদ পাশ করলে চেয়ার টেবিলও পাশ করবে।যাক, যথা সময়ে পরীক্ষা হয়ে গেল।

তখন পরীক্ষা শেষে ৩মাস সময় পাওয়া যেতো। এ সময়ে রামপদ এবং বাপ্পি পলেটেকনিকে কি একটা কোর্সে ভর্তি হয়ে গেল। বাপ্পি এক দিন বললো—রামপদের কাছে প্রায়দিনই বাসের ভাড়া থাকে না। বাসের লোকজন তার সাথে দূরব্যবহার করে গায়ে ধাক্কা ধাক্কিও করে। তার নিজের টাকাও সিমিত’। এতো কিছুর পরও রামপদ থেমে যায়নি। পরদিন আবার গেছে আবারও একই ঘটনা ঘটতো।
এবার আমাদের রামপদের দিনবদলের কথা বলি,তার সুখের কথা বলি।

আমাদের রেজাল্ট বের হলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে রামপদ বেশ ভাল ভাবে পাশ করে ফেললো। শুধু কি তাই? পলেটেকনিকের কাগজ দেখিয়ে সে কি একটা কোম্পানিতে ভাল বেতনে চাকুরি নিয়ে ফেললো। আমরা কলেজ ছাড়ার আগেই রামপদ মাশাল্লাহ বিয়েও করে ফেললো। সময় পেলেই তাকে ঘিরে ধরে তার নতুন জীবনের কত যে সিদ্ধ /নিসিদ্ধ গল্প শুনতাম।

ও, হা। এখন রামপদের অবস্থা অনেকের জানা। তবু বলি সে একটা প্রতিষ্টানের চীফ ম্যাকানিক্যাল অফিসার। মোটা বেতনের চাকুরে। পারিবারিক জীবনে ছেলে মেয়ে কতজন জানি না। তবে তার মেয়ের ঘরের নাতিনের জন্য সে বর খোঁজছে। কেউ প্রার্থী থাকলে জাগায় বসে আওয়াজ দিবেন রামপদসহ আমার পৌছে যাবো ইনশাল্লাহ্।

০৭/০৯/১৫

No comments:

Post a Comment

Comments

Not using Html Comment Box  yet?

No one has commented yet. Be the first!

rss