Saturday, October 31, 2015

হীরা



আলমের মন আজ বেজায় খুশী। আজ সে হাসু ভাইদের সাথে কাজে যাবে। আলমের বয়স তেরো। স্থানীয় ভোলাপুর প্রাইমারী স্কুলে সে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে এরপর অভাবের কারনে স্কুল ছেড়ে দিয়ে বাজারের চা দোকানে চাকরি নিয়েছে। এই চা দোকানে হাসুদের দল আড্ডা দিতে আসে। হাসু, রেজাউল, ইদ্রিস একসাথেই থাকে সবসময়। হাসুই আলম কে জিজ্ঞেস করেছে কাজে যাবে কিনা। আলম এক বাক্যে সায় জানিয়েছে। হাসুদের কাজটা সব অর্থেই নিচু। ওরা সীমান্তের ওপার থেকে ফেন্সিডিল এনে ঢাকায় পাঠায়। এদিকের অনেক বাড়ির আয় উপার্জনের উৎস এই কাজ। সীমান্ত আর ঢাকার রেললাইন কাছাকাছি হওয়ায় এই অঞ্চলে ডাইল ব্যবসা রমরমা। বর্ডার থেকে বস্তা ভরা ফেন্সিডিল ট্রেনে তুলে দিতে পারলেই হলো। ট্রেনে তোলাও খুব সহজ। আগের স্টেশন থেকে আলম ট্রেনে উঠে বসে থাকবে। মাল তোলার জায়গা আসার আগেই সে ট্রেনের হাইড্রোলিক প্রেসারের ভালভ খুলে ব্রেক ফেলে দিবে, জায়গা মতো ট্রেন থেমে যাবে। ট্রেনের গার্ড, ড্রাইভার, পুলিশের সাথেও বন্দোবস্ত করা আছে। ওরা অযথা কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে সিগন্যাল পেলে ট্রেন টেনে চলে যাবে।


হীরা চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ শেষ করেছে। সকাল থেকে তার মেজাজ মর্জি খারাপ হয়ে আছে। হীরার সাথে এমিলির হঠাৎ পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম। এমিলিরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে থাকে। সম্পর্কটা অনেক দিনের। গত সপ্তাহে সে বাসায় ব্যাপারটা জানিয়েছে সেই থেকে তার বাবা বাসায় মার্শাল ল জারি করে রেখেছে। তার বাবা প্রাচীনপন্থী মানুষ। ছেলে মেয়ে একে অপরকে পছন্দ করে বসে থাকবে এটা তার কাছে দুঃসহ। ছেলের বাবা আর মেয়ের বাবা একসাথে বসে কথাবার্তা বলবে, একে অপরকে জানবে। এরপর বিয়ের দিনক্ষণ ধার্য করে মুসাফাহা করবে, বিয়ে হতে হয় এভাবে। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন নিজে দেখেশুনে ছেলের বিয়ে দেবেন। সেই থেকে হীরার মন মেজাজ তিরিক্ষি। তার গীটার বাজাতে ইচ্ছে করছে কিন্তু গীটারটা তৌফিক ভাইয়ের বাসায়। সে ঠিক করলো আজই গীটারটা নিয়ে আসবে। এ সময় তার মা এসে বিছানায় তার পাশে বসলো। এই মহিলা আজীবন সরল সহজ। হীরার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল তোর বাবা এমিলির বাবার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। হীরা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। সে জানতো এই অসম্ভব তার মা ছাড়া আর কেউ সম্ভব করতে পারবে না। সে কোন কথা না বলে বিছানা থেকে নেমে শার্ট গায়ে দিয়ে বাইরে চলে এলো। তার চোখে পানি চলে এসেছে, মা দেখে ফেললে লজ্জার ব্যাপার হবে। তিনদিন ধরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। একটা রিকশা নিয়ে সে নয়াবাজার বিশ্বরোডে চলে এলো, এক কাপ চা না খেলে আর হচ্ছে না। চা খাবার জন্য পিন্টুর দোকানে ঢুকে দেখলো তৌফিক ভাই আর জাভেদ ভাই বসে বসে চা সিগারেট খাচ্ছে আর কি নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে। জাভেদকে দেখে হীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
জাবু ভাই চিটাগাং আসলেন কবে? (কোন এক বিচিত্র কারনে সে জাভেদ কে জাবু ভাই বলে ডাকে)
এইতো কালকে আসছি। তোমার খবর কি হীরা?
ভালো আছি ভাই।

এক কাপ চা খেয়ে হীরা তড়িঘড়ি করে আবার বেরিয়ে গেলো। তার হাতে আজ অনেক কাজ। কাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে হবে। এমিলি কে সে তার বাবার সব মেনে নেয়ার কথা বলে সারপ্রাইজ দিবে। এমিলির খুশী খুশী মুখটা ভাবতেই হীরার মন আনন্দে ভরে গেলো। সে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ষ্টেশনের দিকে রওনা হয়ে গেলো, আগামী কালের মহানগর প্রভাতীর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটা টিকেট কাটতে হবে।



হাসু, রেজাউল আর ইদ্রিস এই তিন জনের দলে হাসু অলিখিতভাবে নেতার ভুমিকা পালন করছে। ইদ্রিস তখন থেকে ঘ্যানঘ্যান করছে, আলমকে প্রথম দিনেই একা একা হাইড্রোলিক ফালানোর দায়িত্ব দেয়া ইদ্রিসের মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। হাসু জানে ইদ্রিস একটু খুঁতখুঁতে কিন্তু কাজ করে একদম নিখুঁত। আজ তিন বস্তা মাল চালান যাবে। ক্ষেতের আলে মাল লুকিয়ে রেখে ওরা তিনজন রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি পড়ছে ঝির ঝির করে। ট্রেন মনে হয় আজকে লেট। ইদ্রিস মাথা মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে খারাপ ধরনের একটা গালি দিলো। বোঝা গেলোনা গালিটা কাকে দিলো, বৃষ্টিকে নাকি ট্রেনকে। এসময় দূর থেকে ট্রেনের হুইসেল ভেসে এলো। ট্রেনের হুইসেল শুনে ওদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেলো। তিনজন মিলে টেনেটুনে ভারি বস্তাগুলো লাইনের পাশে জড়ো করলো। ততক্ষণে ট্রেন কাছে চলে এসেছে। হাসুর চোখে কেমন একটা অস্বাভাবিকতা ধরা পড়লো। গাড়িটা যেন দ্রুত থেমে যাচ্ছে আর হাইড্রোলিকের বাতাস বেরিয়ে যাবার শব্দটা অনেক বেশি। হঠাৎ দেখলো ট্রেনের জানালা থেকে কি যেন ছিটকে পরলো সিগন্যাল পোস্টের গায়ে।

মাল লইয়া দৌড় দে বলে এক চিৎকার দিয়ে হাসু একটা বস্তা কাঁধে তুলে নিয়ে ঢুকে পড়লো ভুট্টা ক্ষেতের ভিতর। ইদ্রিস আর রেজাউলও দৌড় দিলো হাসুর পিছনে পিছনে।

হীরার সিট পড়েছে জানালার পাশে। ট্রেন চলছে। বাতাসটা বেশ ভালো লাগছে তার। বৃষ্টি হচ্ছে অল্প অল্প, বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে গায়ে। দারুন লাগছে। হীরা সিট থেকে উঠে টয়লেটের কাছে গিয়ে দেখলো অল্পবয়সী লুঙ্গি পরা একটা ছেলে টয়লেটের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা চটের ব্যাগ। কেমন নার্ভাস চেহারা ছেলেটার। দরজা ছাড়তে চাইছে না। হীরা ছেলেটাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে টয়লেটে ঢুকলো। টয়লেটের দরজায় যে দাঁড়িয়ে ছিলো সে হচ্ছে আমাদের পরিচিত চা দোকানের কর্মচারী আলম। গল্পের শুরুতেই তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। হীরা বেরিয়ে যেতেই আলম দ্রুত ট্রেনের টয়লেটে ঢুকে পড়লো। ব্যাগ থেকে যন্ত্রপাতি বের করে দ্রুত হাতে টয়লেটের দেয়ালের একটা প্যানেল সরিয়ে ফেলল সে। এই প্যানেলের নিচ দিয়ে হাইড্রোলিক প্রেসারের পাইপটা গিয়েছে। জরুরি প্রয়জনে বাতাস ছেড়ে দেবার জন্য এখানে একটা ভালভ লাগানো আছে। আলম ভালভটা খুলে দিতে লাগলো দ্রুততার সাথে। হঠাৎ কি যেন হলো, প্রচন্ড শব্দ করে বাতাস বের হয়ে যেতে শুরু করলো আর ঝাঁকুনি দিতে দিতে থেমে যাওয়া শুরু করলো ট্রেনটা। আলম বুঝলো কিছু একটা গড়বড় হয়েছে, সে উঠে দিগ্বিদিক দৌড় শুরু করলো ট্রেনের করিডোর ধরে।
হীরা সিটে এসে বসতেই বিকট একটা শব্দ শুনতে পেলো আর দেখলো গাড়িটা বিপদজনকভাবে দুলতে দুলতে গতি কমাচ্ছে। টয়লেটের সামনে দেখা ছেলেটাকে পাগলের মতো দৌড়ে যেতে দেখলো হীরা। বিদ্যুৎচমকের মতো তার মাথায় এলো যে ট্রেনটা দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে এবং তার উচিত এক্ষুনি গাড়িটা থেকে বেরিয়ে যাওয়া। আর কিছু না ভেবেই হীরা ট্রেনের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়লো এবং কিছু একটার সাথে প্রচণ্ডভাবে বাড়ি খেয়ে তীব্র ব্যাথার অনুভুতি নিয়ে চেতনা হারালো।

জাভেদ সকাল এগারোটা বিশে ইউনিক সার্ভিসের একটা বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। বৃষ্টি হচ্ছে থেমে থেমে। ভ্রমনের জন্য চমৎকার আবহাওয়া। বাস তখন মিরসরাইতে রেল লাইনের সমান্তরালে চলছে। এমন সময় জাভেদের মোবাইলে একটা ফোন এলো। তৌফিক করেছে। তৌফিক কিছু একটা বলল জাভেদকে। জাভেদ আরো কিছু কথা জিজ্ঞেস করে ফোন রেখে দিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো তাকিয়ে রইলো বর্ষায় ভেজা রেললাইনের দিকে। ঘণ্টা খানেক আগে এই লাইন ধরে গিয়েছিলো হীরা, তার প্রেমিকাকে একটি সুসংবাদ দেয়ার জন্য। একটি স্বপ্ন দেখানোর জন্য।

হীরা মারা গেছে।

(এই গল্পের সবই কাল্পনিক। শুধু হীরার অংশটা ছাড়া। হীরা আমার বন্ধু এবং ছোট ভাই। হীরার গীটারটা এখনো আমার বন্ধু তৌফিকের কাছে আছে। আমি যখন জীবিকার কারনে চট্টগ্রামে পাঁচ বছর একা ছিলাম তখন আমার গীটার ছিলোনা, গীটার কিনার টাকাও ছিলোনা। তৌফিক হীরার গীটারটা আমাকে দিয়েছিলো বাজানোর জন্য। আমি সাড়ে তিন বছর হীরার গীটারটা ব্যবহার করেছি। তখন গীটারটির কিছু ছবি তুলেছিলাম আমার মোবাইল দিয়ে। ছবিতে যে গীটারটা দেখা যাচ্ছে তা আমার বন্ধু ও ছোটভাই হীরার। ছেলেটা বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে চলে গেছে। তারিখটা ছিলো ২০০৮ সালের ১৭ মে।)

No comments:

Post a Comment

Comments

Not using Html Comment Box  yet?

No one has commented yet. Be the first!

rss