যাদের জীবনে কখনো কলোনিতে থাকার সুযোগ হয় নি তাদের এই লেখাটি পড়া ঠিক হবেনা
কারণ এটা তাদের ‘জীবনে কি কি মিস করেছি’
সেই তালিকাটা বড়ই করবে কেবল। আমার জীবনের
প্রায় ১৪ বছর কেটেছে এই সিএসএম কলোনীতে। ১৪ বছর মানে তো সুস্থ সবল বাঙ্গালি জীবনের
প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। আর জীবনের ১৪ বছরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় আর কি হতে
পারে। মানুষ হিসেবে আমি কেমন হব, আমার
চিন্তা-ভাবনা কেমন হবে সবই তো ঐ সময়টায় সচেতন বা অচেতন ভাবে শিখেছি। বাংলাদেশের
প্রায় সব কলোনির কাহিনী, জীবন-চিত্র
প্রায় একই রকম বড়জোর উনত্রিশ-ত্রিশ পার্থক্য (‘বদলে যাও বদলে দাও’ মৌসুম চলছে বলে বহুল প্রচলিত উনিশ-বিশ বাগধারাটা বদলে দিলাম!) তাই সবার সাথে
সেই অভিজ্ঞতাগুলো ভাগাভাগি করার লোভ সামলাতে পারলাম না!
বাড়ি অনেক কিন্তু ঘর একটাই…
কলোনির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল শিশু কিশোরদের জন্য কলোনিতে আসলে নির্দিষ্ট কোন
বাসা নেই। সকালে হয়তো নিজের বাসায় খাওয়া-দাওয়া সারা হল, দুপুরে আরেক বাসায়, রাতে আরেক বাসায় এমনকি অন্য বাসায় ঘুমানো খুব একটা
অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। এখনকার এপার্টমেন্ট সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা শিশু কিশোররা
স্বপ্নেও হয়তো এতোটা আশা করবে না। নিজ বিল্ডিং তো অবশ্যই এমনকি মোটামুটি আশেপাশের
কয়েকটা বিল্ডিং এর সবাই সবার কুশলাদি জানত। কারও বাসায় ভালো খাবার রান্না হলে
প্রতিবেশীর অনুজদের দাওয়াত প্রাপ্তি বা সে রান্না পাঠানো নিশ্চিত ছিল। বিকালে
অথবা রাতে হাটতে বের হলে সবার সাথেই সবার দেখা সাক্ষাৎ হত। তখন আমার কাছে এসবই খুব
স্বাভাবিক দৃশ্য ছিল, আমি ধরেই নিয়েছিলাম এমনই
তো হওয়ার কথা। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সমানুপাতিক হারে আমি বুঝতে পেরেছি কি
অদ্ভুত সুন্দর মায়ায় জড়ানো, অদ্ভুত সুন্দর
সময়ই না ছিল সেটা।
খেলার মাঠে ধুলা :
প্রায় সব কলোনির মতো আমাদের কলোনিতেও খুব সুন্দর দু তিনটা মাঠ ছিল।আর ছিলো
প্রতি বিল্ডিং এর সামনে অনেক খোলামেলা জায়গা।আমরা মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল খেলতাম।
আমরা সবাই মৌসুমি খেলোয়াড় ছিলাম। শীতকালে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, বর্ষাকালে ফুটবল এভাবেই চলত। দেখা যেত সবাই কম বেশী সব খেলাই পারত এই জন্যেই
বোধ হয় পরবর্তীতে কেউ আর কিছুই পারত না। খেলার মাঠে মারামারি, মন কষাকষি একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। বিশেষ করে
ক্রিকেটে কে আগে ব্যাটিংয়ে নামবে তা নিয়ে প্রায়শই গোল বাধত। এইসব হাতাহাতি,
মারামারি আর মন কষাকষি করতে করতেই ঐ মাঠ যে কত
বন্ধু উপহার দিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। XYZ সাহেবের সাথে ঝামেলার আগ পর্য়্যন্ত মাঠটার সাথে ভালোই
ঘনিষ্ঠতা ছিল।
শুক্রবার :
শুক্রবার মানেই কলোনির সাপ্তাহিক ঈদ। বাসা থেকে তাড়াতাড়ি বের হতাম ঠিকই তবে
সেটা হুজুরের খুতবা শোনার জন্য নয়। আমরা মসজিদের অদূরেই কবরস্থানে বসে খুতবা
উপেক্ষা করে রাজা উজির মারতাম আর কান খাড়া করে রাখতাম কখন ভেসে আসবে ‘আস্কুরুনি ওলা তাকফুরুন’। এইটা শোনার সাথে সাথেই মসজিদের দিকে দে দৌড়। কোনোমতে শেষ
কাতারে দাঁড়াতাম এবং সবসময়ই সব মসজিদে একজন ইমানদার মুমিন লোক পাওয়া যায় কাজ
হচ্ছে ছোটদের উপর হম্বি তম্বি করা, তার ঝাড়ি
শুনতাম। যেহেতু শরিয়তে আছে রুকুতে যাওয়া পর্যন্ত নামাজ ধরা যাবে তাই আমরা এই
সর্বোচ্চ সুবিধাটা আনন্দ-চিত্তে গ্রহণ করতাম এবং বিভিন্ন ফাতরামি করে নামাজে
দাঁড়ানো অন্যান্য মুমিন মুসলমানদের ঈমানের শক্ত পরীক্ষা নিতাম। নামাজে দাঁড়ানোর
পরও আমাদের ঘাড়ের শয়তানের দম ফেলার ফুরসত ছিল না। বেশিরভাগ সময়েই সেজদায়
যাওয়ার পর কারও পশ্চাতদেশে নির্মমভাবে আঘাতের দুমদাম আওয়াজ পাওয়া যেত এবং সালাম
ফেরানোর পরে দেখা যেত কয়েকজন ঘটনা ঘটিয়ে নামাজ শেষ হওয়ার আগেই জীবনহানির
আশঙ্কায় ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছে। শুক্রবার কম বেশী সবার বাসায়ই ভালো খাবার তৈরি
হতো বলে পুরো কলোনি খাবারের ঘ্রাণে মো মো করত সুতরাং নামাজের পর বাইরে আর সময়
নষ্ট করার মানেই হয় না।
কলোনিয়াল প্রেম:
আমাদের কলোনি অনেক উঠতি প্রেমিক-প্রেমিকার বিচরণক্ষেত্র ছিল। তবে তাদের
প্রেমের পথ ছিল অসমতল। প্রেমিকা যে বিল্ডিংয়ে থাকে প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে সেই বিল্ডিংয়ের সামনে টহল প্রদান, উঁচু গলায় গান পরিবেশন বা শিষ প্রদানের মাধ্যমে প্রেমিকার
দৃষ্টি আকর্ষণ এবং প্রেমিকার পিতা বা মাতাকে ভক্তিভরে সালাম প্রদান ইত্যাদি কর্মের
মধ্যে প্রেমিক প্রবররা নিযুক্ত থাকত।সিড়ির নীচ আর ছাদ ছিলো প্রেমের অন্যতম স্থান।
কতপ্রেমের অকাল মৃত্যু ,কিছু প্রেমের
সুন্দর সফলতা , তবে ট্যাংকীর নীচে
কৃত্তিম শ্বাষ প্রশ্বাষে থাকা প্রেমের পূন:জীবন লাভ ছিলো কলোনীর প্রেমের শ্রেষ্ঠ
ঘটনা।
খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যে ১৪ বছরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা এই কখনই লিখে শেষ করা
যাবে না। কলোনী টা আজ আর নেই, কিন্তু চাইলেই কি
আর নিজের আঁতুড়ঘরকে ভুলে থাকা যায় ?এখনো পুরো কলোনীটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। মাঝে মাঝে চিন্তা করি যে পরিবেশে আমি
এবং আমরা বড় হয়েছি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি সেই আনন্দময় পরিবেশ পাবে? ভয় হয় এরা হয়তো বড় হবে কবুতরের খোপের মতো এপার্টমেন্টে,
কবুতর হিসেবে, মানুষ হিসেবে নয়।
(আইডিয়া যোগাড়কৃত)
No comments:
Post a Comment