Friday, October 9, 2015

গানের নাম "পাপড়ি"। হ্যাঁ, আজম খানের পাপড়ি।



আজ সকালে অফিসে যাওয়ার সময় পরিচিত একটা গান কানে এলো। বহু বছর পর গানটা শুনলাম। গানের নাম "পাপড়ি"। হ্যাঁ, আজম খানের পাপড়ি। পাপড়ি কেন বোঝেনা তাই ঘুম আসেনা। আমার প্রজন্মের মানুষের জীবনে আজম খান একটা বিশাল অংশ জুড়ে আছে। আজ সারাদিন গুরুকে মনে পড়ছিল। ৫ জুন গুরুর মৃত্যু বার্ষিকীতে গুরুকে নিয়ে আমি দুলাইন লিখেছিলাম।


আমি তখন ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ি। তখন টেপ রেকর্ডারের যুগ। বাজারে TDK, Sony কোম্পানির ষাট মিনিট আর নব্বই মিনিটের টেপ কিনতে পাওয়া যেত। আমরা আবার নষ্ট হয়ে যাওয়া টেপ থেকে ফিতা খুলে এখানে ওখানে টানা দিয়ে বেঁধে রাখতাম, বাতাস এলে ভ্রিইই ভ্রিইই শব্দ হয়। আমরা বলতাম ক্যাসেটের গানগুলোই বাজছে। তখনো আমাদের বাসায় কোন ক্যাসেট প্লেয়ার নেই। গান নিয়েও তেমন ধ্যান ধারনা ছিলনা। সেসময় আমাদের ক্লাসে নতুন একটা ছেলে ভর্তি হল, নাম জয়নাল আবেদিন। তার বাবা হুজুর ধরনের মানুষ। সফেদ দাড়ি আর তিনগজি আলখাল্লা পড়ে থাকে। জয়নাল ছেলেটা পিছনের বেঞ্চে আমার পাশেই বসত বেশির ভাগ সময়। কথাটথা হতনা খুব একটা। সারাদিন গুনগুন করে অদ্ভুত সুরে কি যেন গাইতো। অনেক চেষ্টা করেও ওর গানের কথা আবিস্কার করতে পারিনি অনেকদিন। একদিন ক্লাসে স্যার নেই, ব্যাপক হইহল্লা হচ্ছে। সম্ভবত চীনা আলম তার স্বভাবসুলভ খবিসি জোকের ভাণ্ডার খুলে বসেছে, সবাই হাহা হোহো করছে। জয়নাল পিছনের বেঞ্চে বসে একা একা গুনগুন করে যাচ্ছে। হইচইয়ের কারনে একটু জোরেই গাইছে। আমি কুত্তার মত কান বাগিয়ে বসে আছি যদি কিছু বুঝা যায়। শেষ দুটা শব্দ শুধু বুঝতে পারছি "তোমাকে আমার"। হঠাৎ একটু বেশিই জোরে গেয়ে ফেলল আর আমিও শুনে ফেললাম। "হৃদয়ের টানে আরো কাছে আনে তোমাকে আমার"। কেমন অদ্ভুত নিয়ম ভাঙ্গা সুর। আমরা তখনো "তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে মরন যাত্রা যেদিন যাবে" ধরনের সুর শুনে অভ্যস্ত। গানের কথা আবিস্কার করে আমি ক্লাসে মোটামুটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটালাম। এরপর বহুদিন জয়নালকে আমরা "হৃদয়ের টানে" নামে ডাকতাম। 


হ্যাঁ, অদ্ভুত ব্যাপার তখনো আমরা আযম খান নামের শিল্পীটিকে চিনতাম না। আর যখন চিনলাম তখন তাঁর বেসুরো সুরের গান শুনে শুরুতেই একচোট হেসে নিতাম। কি আশ্চর্য মাত্র দুই কি তিন মাসের মাথায় আমরা আযম খানে মজলাম। কি তাঁর বাচন ভঙ্গি, কি তাঁর স্টাইল, কি তাঁর গায়কি। বড় ভাইদের কাছে জানলাম আযম খানকে গুরু নামে ডাকা হয়। বাসায় গান শুনার যন্ত্র নেই বলে মন ভরে শুনতেও পারিনা, এখানে ওখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আযম খানের গান শুনি। তখন দোকানিরা অনেক অমায়িক ছিল, দোকানে গিয়ে কোন ক্যাসেট দেখিয়ে বাজাতে বললে আগ্রহ সহকারে বাজিয়ে শোনাত। এভাবে গুরুর সব গান শুনে মুখস্ত করে ফেললাম। কি অদ্ভুত সব গান। অনামিকা চুপ, হায় বাংলাদেশ, সালেকা মালেকা, আলাল দুলাল, আসি আসি বলে তুমি আর এলেনা, আমি যারে চাইরে। কেউ কি কখনো ভাবতে পেরেছিল "তাদের বাবা হাজি চান চানখার পুলে প্যাডেল মেরে পৌছে বাড়ী" কোন গানের লিরিক এমন হতে পারে? "হারিয়ে গেছে খুঁজে পাবোনা" এই গানটা শুনলে কষ্টে বুকের পাঁজর ভেঙ্গে যেত যেন। আরো আছে "অভিমানি তুমি কোথায় হারিয়ে গেছো" (এই গানটা দিয়েই আমার গীটারের শুরু)। আমরা তখন গতানুগতিক কথা আর সুরের গান শুনতে শুনতে হঠাৎ রেওয়াজ ভাঙ্গা সুর আর কথা পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। 

এই অদ্ভুত মানুষটা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সমরে যার উপস্থিতি সঙ্গীতে তাকে ভাবা যায়না অথচ যুদ্ধ শেষেই আযম খান স্বাধীন দেশে গড়লেন প্রথম ব্যান্ড "উচ্চারণ"।

মানুষটা আজীবন ছিলেন বাচ্চাদের মত। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আগপর্যন্ত নিয়মিত জসিমউদ্দিন রোডের (কবি জসিমউদ্দিনের বাড়ি এই সড়কে ছিল। আযম খানের লেখায় জসিম উদ্দিনের গাছের কাঁঠাল চুরি করার কাহিনি পড়েছিলাম) ছেলে ছোকরাদের নিয়ে ক্রিকেট খেলতেন। এলাকার আণ্ডা বাচ্চাদের নিয়ে সুইমিং পুলে যেতেন সাঁতার কাটতে। 

সেই যে আমার গান শোনা শুরু এখনো শুনছি। আযম খান আমার গান শোনার কান তৈরি করে দিয়ে গেছেন। আযম খানের মুখ ভরা দাড়ি ছিল। দাড়িওয়ালা আযম খানকেই আমার ভালো লাগত। দাড়ি ফেলে দেয়ার পর মনে হতো যেন গুরুর পাওয়ার কমে গেছে। আযম খান কখনই তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি। তিনি ঠিকমতো তাঁর গানের রয়্যালিটির টাকা পাননি বলে জনশ্রুতি আছে। এসব নিয়ে তাঁর কোন মাথাব্যাথা ছিল বলেও কখনো মনে হয়নি। কিছুটা আক্ষেপ হয়ত ছিল তাই হয়ত গেয়েছেন "জীবনে কিছু পাবোনা রে ভুলিনি সেই ভাবনা"।

এই সাদাসিধে বোকা মানুষটা দিয়েছে অনেক। দেশকে দিয়েছে স্বাধীনতা, দেশের সঙ্গীতকে দিয়েছে প্রান। বিনিময়ে নেয়নি কিছুই।
আজ ৫ জুন। আযম খানের চতুর্থ মৃত্যু বার্ষিকী। গুরুকে সালাম।

No comments:

Post a Comment

Comments

Not using Html Comment Box  yet?

No one has commented yet. Be the first!

rss