সাতটা বিশে বাস। এলার্ম দিয়েছি পাঁচটা ত্রিশে। পাঁচটা চল্লিশে রিপন ভাইয়ের ফোন পেলাম। উঠে প্রথমে কিছুক্ষন বাজে ফোন সেটটাকে গালাগালি করলাম টাইম মত এলার্ম না দেয়ার জন্য। এরপর ফ্রেশ হয়ে ছয়টা দশের দিকে মহাখালীর দিকে ছুটলাম। ছুটন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করলাম আমি পাঁচটা ত্রিশের বদলে ছয়টা ত্রিশে এলার্ম দিয়ে রেখেছি, আমি যখন পথে তখন আমার মোবাইল প্রানপনে আমার ঘুম ভাঙ্গাবার চেষ্টা করছে। গলা চেপে ধরে মোবাইলের চিল্লাচিল্লি থামানো হলো। গিয়ে দেখি রিপন ভাই আগেই হাজির। রিপন ভাইকে খুঁজতে খুঁজতেই আপেল আর নাসেরের সাথে দেখা। রিপন ভাই ততক্ষনে নেত্রকোনা যাবার টিকেট কেটে ফেলেছে। এরপরই আমরা চারজন নাস্তা খেতে বসলাম। মেনু হলো হাতে বেলা রুটি আর আলু দেয়া মিষ্টি কুমড়ার পেস্ট। সবাই সাথে ডিম নিলো। আমার সাত সকালে মুরগি বেচারির এমন সর্বনাশ করতে ইচ্ছা করল না। আমি ডিম নিলাম না।
যেহেতু মিষ্টি কুমড়া মিষ্টি তাই মিষ্টি কমাতে এমন ঝাল দিয়েছে যে আমাকে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে খেতে হয়েছে। খাওয়ার শুরুতে পুরোদস্তুর এ্যাথলেটদের মত সাজসজ্জা করে রফিক ভাই চলে এলেন আর খাওয়াদাওয়ার শেষ মুহুর্তে এসে হাজির হলেন সামী ভাই। একদম সাতটা বিশেই বাসে উঠে বসলাম। উঠেই শুনি বাসে হেল্পার নেত্রকোনাবাসীকে সমানে গাল দিচ্ছে। গাজীপুর পর্যন্ত যতবার বাস থেমেছে ততবারই হেল্পার বাস থেকে নেমে এই বিশেষ জেলাকে গালাগালি করেছে। বারবার শুধু বলছে "নেত্রকোনা মদন, নেত্রকোনা মদন"। আসলে নেত্রকোনার পরের স্টপেজের নাম মদন। আমরা যাচ্ছি বন্যা আপার বাবার জন্য দোয়া কামনা করার জন্য। বন্যা আপা আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। গাজিপুরের কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ বাস শম্বুক গতিতে চলা শুরু করলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো ব্রেক ওয়েল শেষ হয়ে গিয়েছে তাই ব্রেক কাজ করছে না। আমার চেয়ে ভুলোমনা মানুষ পৃথিবীতে আরেকজন আছে ভেবে বেশ শান্তি অনুভব করলাম আমি। যাই হোক, ব্রেক ওয়েল কিনে নিয়ে তুমুল গতিতে গাড়ি চলা শুরু হলো। এরপর আবার বিপত্তি। হঠাৎ বিকট শব্দ। চাকা পাংচার হয়ে গেছে। তখনো নেত্রকোনা ৭৩ কিলোমিটার দূরে। একেবারে মাইলস্টোনের সামনে এসেই গাড়িটা থেমেছে। আমরাও মাইলস্টোনকে ঘিরে কিছু ছবি তুলে নিলাম।
নেত্রকোনা পৌঁছলাম সাড়ে এগারটার দিকে। শুরুতেই হোটেলে দুটি রুম নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম সবাই। এরপর আর তেমন কোন ঘটনা নেই। বন্যা আপার বাড়িতে গেলাম। যা হয়, একটু কান্না, অনেকটা মন খারাপ, মাঝে মাঝে ছোট ছোট কিছু নিয়ে হাসাহাসি। সব ধর্মেই প্রিয়জনের চলে যাওয়ার পর শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে দোয়া বা মঙ্গল কামনা করার একটি ব্যাপার আছে। আমার ধারনা শোককে সহনীয় করতেই সব ধর্মে এই আয়োজন রাখা হয়েছে। মানুষের শরীরটা চলে যায়, রেখে যায় অনেক কিছু। একটা টুথব্রাশ, একটা চিরুনী, একজোড়া স্যান্ডেল, নিজ হাতে যত্ন নেয়া গাছ, বাড়ির সামনে লাগানো নেমপ্লেট এমন হাজারো বস্তু। হাজারটা স্মৃতি। বস্তুগত স্মৃতি ছাড়াও রেখে যায় আরো কত কিছু। হয়তো জংলা থেকে ভেসে আসা বকুল ফুলের গন্ধে অকারনেই প্রিয়জনকে মনে পড়ে, দূরে মাইকে বাজতে থাকা কোন গান যা ছিলো চলে যাওয়া মানুষটির প্রিয়। হয়তো পথে অচেনা কোন মানুষকে দেখে একই অবয়ব বলে ভ্রম হয়। হয়তো মুগ ডাল দিয়ে মাছের মুড়ো রাঁধতে গিয়ে অজান্তেই অশ্রু গড়ায়, আহা মানুষটা মুড়িঘন্ট বড় পছন্দ করতো। মানুষের হৃদস্পন্দন থেমে যায় কিন্তু কখনোই একদম নিঃশেষ হয়ে যায়না কেউ। কিছু না কিছু রেখেই যায়।
No comments:
Post a Comment