আজ থেকে ২৫ বছর আগের কথা।১৯৯১ সাল।খুব সম্ভবত ক্লাস সেভেনে পড়ি।২৯ শে এপ্রিল নিয়ে লিখিতভাবে স্মৃতিচারণ সম্ভবত এই প্রথম,তা ও csm এর কল্যাণে।এই পেইজের অনেকে তখনো এত ছোট ছিল যে ২৯শে এপ্রিল ১৯৯১ বলে তাদের জীবনে কিছু ঘটেনি কিংবা অনেকের জন্ম ৯১ সালের ও পরে।যাদের কাছে এ স্মৃতিচারণ রূপকথার মতো ও মনে হতে পারে।
স্কুলের এস এস সি পরীক্ষার্থীদের ফেয়ারওয়েল ছিল সেদিন। সিগনাল ক্রমাগত উর্ধমুখী হওয়ার কারণে তড়িঘড়ি করে ফেয়ারওয়েলের সমাপ্তি। তখনো কেউ আঁচ করতে পারেনি কি ভয়ানক প্রাকৃতিক দূর্যোগ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।ঘুনাক্ষরে ও বুঝতে পারিনি এ রকম ভয়াবহ কিছু হবে।কারণ ঘূর্ণিঝড়ের সাথে তখনো পরিচিত হলে ও জলোচ্ছ্বাসের সাথে একেবারে আঁনকোড়া। খালা খালু এসেছে বেড়াতে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর বিটিতে ঘোষণা আসছে ৮ নং,৯ নং,১০ নং মহা বিপদসংকেত।কিন্তু সেদিকে কারো খেয়াল নেই।সবাই যথাসময়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘমিয়ে পড়েছে।কখনো কি ভেবেছিল কালকের সকালটা অনেকেরই আর দেখা হবে না।দেখা হবে না বউ বাচ্চা,মা বাবা,কিংবা ভাইবোনের সাথে।দেখা হবে না প্রিয় সন্তানেরমুখ।
রাত বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে ঝড়বৃষ্টি আর বাতাস।যখন আম্মা ঘুম থেকে ডেকে দিল তখন ঘড়ি দেখি রাত ১২ টা।ঝড়ের ঝাপটার কারণে দরজার নিচ দিয়ে পানি ঢুকছে।কাঁচের জানালা দিয়ে দেখলাম-নারিকেল গাছ গুলো যেন স্রষ্টার প্রণাম করছে।মাথাটা একবার মাটিতে নুয়ে পড়ে আবার দাঁড়িয়ে যায়।এ এক অন্যরকম অনূভুতি।বাসার সবাই জোরে জোরে কুরআন শরীফ পড়ছে।
সম্ভবত রাত ২ টা।হঠাৎ চিৎকার পানি পানি।অনেক কষ্টে দরজা খুলে দেখি পানি ইতিমধ্যে নিচতলায় ঢুকে পড়েছে এবং ক্রমাগত পানি বাড়ছে।নিচতলায় হৈ হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল,যে যা পেরেছে নিয়ে দু'তলায় উঠে আসছে।বাসার সব জিনিসপত্র ভিজে টুইটম্বুর।দুতলা থেকে দেখতে পাচ্ছি,বড় বড় লাগেজ,তেলের ড্রাম,বাজারের কাঁচা তরিতরকারী সবই ভেসে যাচ্চে পানিতে।
পরদিন সকালবেলা।বাতাস থেমে গেছে।পানিতে কমতে শুরু করেছে।যখন পানি হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে তখন বের হলাম বাসা থেকে।বাজার গেইট দিয়ে বের হয়েই দেখলাম মুদি দোকানের লোকজন চাল ডাল সবই দোকান থেকে ধরাধরি করে বের করছে।দূর্গন্ধে দাঁড়ানো যাচ্চে না।ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে সরকারী উদ্ধার তৎপরতা। কিছুক্ষণ পর পর একটা করে ট্রাক আসছে আর দূর্গন্ধে সবাই হাত দিয়ে নাক চেপে ধরছে।সবই ছিল মৃত মানুষের লাশ।লাশে লাশে সয়লাব তখন সিভিছ,নেভাল ও আশপাশের এলাকা। কলোনীতে সবাই আসছে আত্মীয়স্বজনদের দেখতে।
সেই জলোচ্ছ্বাসে একলক্ষ চল্লিশ হাজার লোক মারা গিয়েছিল।এমন ও অনেক পরিবার আছে যাদের পরিবারে আর কোন সদস্যই জীবিত ছিল না।ছোট চাচার আসল আমাদের দেখতে,উনার সাথে গেলাম সিভিছ এলাকায়,লাশ আর লাশ।মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে।বছর ফিরে আবার আসে ২৯ শে এপ্রিল। আমরা স্মরণ করি সেই সব মৃত মানুষদের,যারা প্রাণ হারিয়েছিল এই প্রলয়কারী ঘূর্নিঝড়ে।তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি।
No comments:
Post a Comment